Thursday, December 3, 2015

পারিবারিক জীবনে অধীনস্ত খাদেমদের অধিকার


পারিবারিক জীবনে অধীনস্ত খাদেমদের অধিকার
ডাঃ গাজী মোঃ নজরুল ইসলাম

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা'য়ালার জন্য যিনি রব্বুল আলামীনদুরুদ ও সালাম রসূলুল্লাহ্ সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি যিনি রহমাতুল্লিল আলামীন, তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কিরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) এবং সালেহীন (র)-গণের প্রতিআমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাইআমরা আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর বান্দাহ ও রসূলনিশ্চয়ই শুভ পরিণতি শুধুমাত্র মুত্তাকীনদের জন্য নির্ধারিত।

প্রাক-ইসলামিক এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগে দাস-দাসী প্রচলন ছিল ইসলামের সুমহান শিক্ষায় মানুষের দাসত্বের শৃংখল থেকে মানবতা মুক্তি পেয়েছে। বর্তমানে খাদেম বলতে পরিবারের মধ্যে বাসা-বাড়ির কাজের লোক, খেদমতগার ও কর্মচারীগণকে বুঝায়খাদিমগণ আমাদের মতই মানুষ হিসাবে আমাদেরই অধীনে ন্যাস্ত থাকায় আমাদের উপর তাদের ন্যায়সংগত অধিকার রয়েছে। আমাদের সে সব হক সম্পর্কে জানতে হবে এবং সচেতনতার সাথে হকসমূহ আদায় করতে হবে। যেমন-

খাদেমদের সাথে উত্তম ব্যবহারঃ হযরত মারূর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিতআমি একবার রাবাযা নামক স্থানে হযরত আবুযর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর সাথে সাক্ষাত করলামতখন তার পরনে ছিলো এক জোড়া কাপড় (লুঙ্গি ও চাদর) আর তার চাকরের পরনেও ছিলো ঠিক একই ধরনের এক জোড়া কাপড়আমি তাকে এই ধরনের সমতার কারন জিজ্ঞাসা করলামতিনি বললেনঃ একবার আমি এক ব্যক্তিকে গালি দিয়েছিলাম এবং আমি তাকে তার মা সম্পর্কে লজ্জা দিয়েছিলামতখন রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেনঃ আবুযর, তুমি তাকে তার মা সম্পর্কে লজ্জা দিয়েছ? তুমি তো এমন ব্যক্তি, তোমার মধ্যে এখনো বাতিল যুগের স্বভাব রয়েছেজেনে রেখো, তোমাদের দাস-দাসী তোমাদেরই ভাইআল্লাহ্‌ তাআলা তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেনতাই যার ভাই তার অধীনে থাকবে, সে যেন তাকে নিজে যা খায় তাকে তা-ই খাওয়ায় এবং নিজে যা পরে, তাকে তা-ই পরায়তাদের উপর এমন কাজ চাপিয়ে দিও না, যা তাদের জন্য বেশী কষ্টকরযদি এমন কষ্টকর কাজ করতে দাও, তাহলে তোমরাও তাদের সে কাজে সাহায্য করবে- (সহীহ বুখারী)

হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, "আমি হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ১০ বৎসর যাবৎ খেদমত করেছি, কিন্তু তিনি আমাকে কখনো উহ্ শব্দটিও বলেন নি, আর না কখনো বলেছেন যে, এটা কেন করছ বা ওটা কেন করনি।" -(বুখারী ও মুসলিম)

খাদেমদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করাঃ হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিততিনি বলেন, আমি দশ বছর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে ছিলাম, (বলাবাহুল্য, সকল কাজ তাঁর মনের চাহিদা মোতাবেক হত না), কিন্তু কখনো তিনি উফশব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। তদ্রূপ একথাও বলেননি যে, এটা কেন করেছ? বা এটা কেন করনি? ঘরের কেউ কিছু বলতে চাইলে তিনি বাধা দিয়ে বলতেন, বাদ দাও, যা হওয়ার ছিল, হয়েছে।  -{বুখারীঃ হাদীস নং ২৭৬৮}

সহীহ আকিদা শিক্ষা প্রদানঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে লক্ষ্য করে বলেন :  "হে বৎস! আমি তোমাকে কয়েকটি বাক্য শিখাতে চাই। তুমি আল্লাহর অধিকারের হেফাযত করবে, আল্লাহও তোমার হেফাযত করবেন। তুমি আল্লাহর অধিকারের হেফাযত করবে, তুমি তাঁকে সর্বদা সামনে পাবে। যখন কোন কিছু চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই চাইবেআর যখন সহযোগিতা চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে। আর জেনে রাখ! যদি পুরো জাতি যদি তোমার কোন উপকার করার জন্য একতাবদ্ধ হয়, তবে তোমার কোন উপকার করতে সমর্থ হবে না, শুধু ততটুকুই করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেনআর যদি পুরো জাতি যদি তোমার কোন ক্ষতি করার জন্য একতাবদ্ধ হয়, তবে তোমার কোন ক্ষতি করতে সমর্থ হবে না, শুধু ততটুকুই করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। কলমের লিখা শেষ হয়েছে এবং কাগজসমূহ শুকিয়ে গেছে।"
- [তিরমিযীঃ ২৫১৬] 

সহীহ দ্বীন শিক্ষা প্রদান করাঃ হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহুআনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেনঃ বেটা! সকাল-সন্ধ্যায় যদি এমনভাবে থাকতে পার যে, তোমার মনে কারো প্রতি বিদ্বেষ নেই তাহলে এমনভাবেই থাক। বেটা! এটি আমার সুন্নত। যে আমার সুন্নতকে যিন্দা করে সে আমাকে ভালবাসে। আর যে আমাকে ভালবাসে সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে। 
-{জামে তিরমিযীঃ হাদীস নং ২৬৭৮}

খাদেমদেরকে উত্তম শিষ্টাচার প্রশিক্ষণঃ হযরত আবু হাফস উমার ইবনে আবু সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তত্ত্বাবধানাধীন বালক (খাদেম) ছিলাম। আমার হাত পাত্রের এদিক-ওদিক যেত। রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেন : খোকা! আল্লাহর নাম লও, ডান হাতে খাবার গ্রহন কর এবং নিকটস্থ খাবার খাও। এরপর থেকে আমি সর্বদা তাঁর শেখানো পদ্ধতিতেই খাবার খাই। -(বুখারী ও মুসলিম)

খাদেমদেরকে বিবাহ দেওয়াঃ আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ "তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত, তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরকেও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।" 
-(সূরা নুরঃ আয়াত ৩২)

আল্লাহ তায়ালা আমাদের খাদেমদেরকে নেককার খাদেম হিসাবে কবুল করুন এবং আমাদেরকে খাদেমদের হকসমুহ যথাযথ ভাবে আদায় করার তৌফিক দান করুন! আ-মী-ন।


পারিবারিক জীবনে হিজাবের ফরজ বিধান পালন


পারিবারিক জীবনে হিজাবের ফরজ বিধান পালন
ডাঃ গাজী মোঃ নজরুল ইসলাম

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা'য়ালার জন্য যিনি রব্বুল আলামীনদুরুদ ও সালাম রসূলুল্লাহ্ সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি যিনি রহমাতুল্লিল আলামীন, তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কিরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) এবং সালেহীন (র)-গণের প্রতিআমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাইআমরা আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর বান্দাহ ও রসূলনিশ্চয়ই শুভ পরিণতি শুধুমাত্র মুত্তাকীনদের জন্য নির্ধারিত।

হিজাব বা পর্দা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান হিজাব শুধুমাত্র নারীদের উপর চাপিয়ে দেয়া কোন বিধান নয়,বরং পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্যই ফরজ এ বিধান যথাযথভাবে পালনের জন্য পুরুষ ও নারী একে অপরের সহায়ক মানবিক মুল্যবোধ নৈতিক মান সংরক্ষণে পর্দার গুরুত্ব অপরিসীম

পুরুষদের হিজাব প্রসংগে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ "(হে রাসূল!) আপনি মুমিন পুরুষদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গর হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন।" -{সূরা নূরঃ আয়াত ৩০ }

পুরুষদের চোখের হিফাজতের ফজিলতঃ হযরত আবু রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ইরশাদ করেন, যে মুসলমানের প্রথম (অনিচ্ছাকৃত) দৃষ্টি কোন মহিলার সৌন্দর্যের  প্রতি পড়ে আর সে সাথে সাথে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় আল্লাহ তাআলা তাকে এমন এক ইবাদতের তাওফীক দান করেন যার স্বাদ সে অন্তরে অনূভব করতে থাকে। -(আহমাদঃ ৫/২৬৪, মেশকাতঃ ২৭০, তারগীবঃ ৩/২৩)

ঘরের ভিতরে নারীদের হিজাব প্রসংগে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ "(ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।
- (সূরা নূরঃ আয়াত ৩১)

ঘরের ভিতরে পরিবারের সদস্যদের চলাফেরা প্রসংগে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ "হে মুমিনগণ! তোমাদের দাসদাসীরা এবং তোমাদের মধ্যে যারা প্রাপ্ত বয়স্ক হয়নি তারা যেন তিন সময়ে তোমাদের কাছে অনুমতি গ্রহণ করে, ফজরের নামাযের পূর্বে, দুপুরে যখন তোমরা বস্ত্র খুলে রাখ এবং এশার নামাযের পর। এই তিন সময় তোমাদের দেহ খোলার সময়। এ সময়ের পর তোমাদের ও তাদের জন্যে কোন দোষ নেই। তোমাদের একে অপরের কাছে তো যাতায়াত করতেই হয়, এমনি ভাবে আল্লাহ তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ বিবৃত করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। তোমাদের সন্তান-সন্ততিরা যখন বায়োপ্রাপ্ত হয়, তারাও যেন তাদের পূর্ববর্তীদের ন্যায় অনুমতি চায়। এমনিভাবে আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহ তোমাদের কাছে বর্ণনা করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।" -(সূরা আন নূরঃ আয়াত ৫৮-৫৯)

ঘরের বাইরে পর্দার কঠোরতা বা হিজাবের সাথে জিলবার ব্যবহার প্রসংগে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ "হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিনদের স্ত্রীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের জিলবাবের কিছু অংশ নিজেদের উপর ঝুলিয়ে দেয়। তাদেরকে চেনার ব্যাপারে এটাই সবচেয়ে কাছাকাছি পন্থা হবে। ফলে তাদেরকে কষ্ট দেয়া হবে না। আর আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়াময়।" 
-[সূরা আহযাবঃ আয়াত ৫৯]

পারিবারিক জীবনে নিকট আত্মীয়-স্বজনদের সাথে পর্দার বিধানঃ হযরত ওকবা ইবনে আমের জুহানী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন : "তোমরা নারীদের নিকট যাওয়া থেকে বিরত থাক। এক আনসারী সাহাবী আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! স্বামী পক্ষীয় আত্মীয় সম্পর্কে আপনি কী বলেন? তিনি বললে, সে তো মৃত্যু।" -[বুখারীঃ ৯/২৪২, মুসলিমঃ ২১৭২, তিরমিযীঃ ১১৭১, আহমাদঃ ৪/১৪৯, ১৫৩]

পুরুষদের সাথে পুরুষদের এবং মহিলাদের সাথে মহিলাদেরও পর্দা রয়েছেঃ হযরত আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ "পুরুষদের পুরুষদের প্রতিও পর্দা আছে; তেমনি, মহিলাদের মহিলাদের প্রতিও পর্দা আছে। কোন পুরুষ অন্য পুরুষের সতরের দিকে তাকাবে না এবং কোন নারী অন্য নারীর সতরের দিকে তাকাবে না। দুজন পুরুষ লোক একত্রে একই কাপড়ে জড়াজড়ি করে ঘুমাবে না। অনুরূপভাবে দুজন মহিলাও একত্রে একই বস্ত্রে জড়াজড়ি করে ঘুমাবে না।" - (মুসলিম)

মহিলাদেরকেও দৃষ্টির হিফাজত করতে হবেঃ উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,আমি একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ছিলাম। উম্মুল মুমিনীন মায়মুনা রাদিয়াল্লাহু আনহাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম উপস্থিত হলেন। এটি ছিল পর্দা বিধানের পরের ঘটনা। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা তার সামনে থেকে সরে যাও। আমরা বললাম, তিনি তো অন্ধ, আমাদেরকে দেখছেন না? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরাও কি অন্ধ? তোমরা কি তাকে দেখছ না? - [সুনানে আবু দাউদঃ ৪১১২ ও ৪৩৬১, তিরমিযীঃ ২৭৭৯ ও৫১০২, মুসনাদে আহমাদঃ ৬২৯৬, শরহুল মুসলিমঃ নববী ১০৯৭ এবং ফাতহুল বারীঃ ৯/২৪৮]  

আজকাল অনেক পর্দানশীল পরিবারের কোন কোন মহিলাকে বেড়ার ফাক দিয়ে বা দরজা-জালানার পর্দার ফাক দিয়ে নতুন বর, নতুন জামাই বা গাইরে মাহরাম পুরুষদের দেখার প্রবনতা পরিলক্ষিত হয়- যা সম্পূর্ণ হারাম।

গায়রে মাহরাম নারী-পুরুষের একান্ত সাক্ষাতে শয়তান উপস্থিত থাকেঃ হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : "যখনই কোনো পুরুষ কোনো নারীর সাথে একান্তে সাক্ষাত করে তখন তাদের তৃতীয়জন হয় শয়তান।"   - [জামে তিরমিযী]

সাদৃশ্য গ্রহণকারী নারী-পুরুষগণ অভিশপ্তঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই সব পুরুষের উপর লানত করেছেন, যারা নারীদের সাদৃশ্য গ্রহণ করে (তাদের মতো আকৃতি, তাদের পোশাক ও তাদের চাল-চলন গ্রহণ করে);আর সেই সব নারীর উপরও লানত করেছেন, যারা পুরুষের সাদৃশ্য গ্রহণ করে। - [সহীহ বুখারী]

অত্যাচারী পুরূষ ও বেপর্দা নারীগণ জান্নাতে প্রবেশ করবে নাঃ হযরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ "জাহান্নামবাসী দুটি দল রয়েছে। যাদেরকে আমি এখনো দেখিনি। একদল এমন লোক যাদের হাতে গরুর লেজের মত লাঠি থাকবে যা দিয়ে তারা লোকদেরকে প্রহার করবে। আর অন্য দল এমন নারী যারা পোশাক পরেও উলঙ্গ থাকে। তারা অন্যদের তাদের প্রতি আকৃষ্ট করবে নিজেরাও অন্যদের প্রতি ঝুঁকবে। তাদের মস্তক উটের পিঠের কুঁজের মত হবে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এমনকি জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ এর ঘ্রাণ এত এত দূর থেকেও পাওয়া যায়।" 
- [মুসলিমঃ ২১২৮]

আধুনিকতা ও প্রগতির নামে হিজাবের ফরজ বিধানের প্রতি শৈথিল্য, আলস্য, অবহেলা,অবজ্ঞা ও বিরোধীতা মুসলিম সমাজের ফ্যাসন হয়ে দাড়িয়েছে পর্দা লংঘন ও অবাধ মেলামেশাকে সমাজে উৎসাহিত করা হচ্ছে ফলে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা বর্তমান মুসলিম সমাজের সর্বত্র মারাত্মকভাবে  মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে আর সমাজের নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ ধ্বংস হচ্ছে

তিনি আরও বলেনঃ "হে মানবসমাজ, পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তু-সামগ্রী থেকে আহার কর। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে নিঃসন্দেহে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। সে তো এ নির্দেশই তোমাদিগকে দেবে যে, তোমরা অন্যায় ও অশ্লীল কাজ করতে থাক এবং আল্লাহর প্রতি এমন সব বিষয়ে মিথ্যারোপ কর যা তোমরা জান না।" -[সূরা বাকারাহঃ আয়াত ১৬৮-১৬৯]

মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার ঘটানোর পরিনামঃ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন : যারা পছন্দ করে যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার ঘটুক তাদের জন্য পৃথিবীতে ও আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তিআর আল্লাহ্‌ জানেন, তোমরা জান না [সূরা আন-নূরঃ আয়াত ১৯]

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে পর্দার ফরজ বিধান মেনে চলার তৌফিক দান করুন! অশ্লীলতা ও বেহাপনার সয়লাবসহ সমাজের সকল প্রকার কলুষতা থেকে রক্ষা করুন! কলুষতার সয়লাব থেকে সমাজকে সংশোধন করে মদীনাতুন্নবীর ন্যায় তাকওয়া ভিত্তিক কল্যাণময় সমাজ গড়ার তৌফিক দিন! এবং তার মাহবুব বান্দাগণের অন্তর্ভূক্ত করুন! আ-মী-ন।


পারিবারিক জীবনে হালাল বা বৈধ উপার্জন


পারিবারিক জীবনে হালাল বা বৈধ উপার্জন
ডাঃ গাজী মোঃ নজরুল ইসলাম

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা'য়ালার জন্য যিনি রব্বুল আলামীনদুরুদ ও সালাম রসূলুল্লাহ্ সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি যিনি রহমাতুল্লিল আলামীন, তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কিরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) এবং সালেহীন (র)-গণের প্রতিআমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাইআমরা আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর বান্দাহ ও রসূলনিশ্চয়ই শুভ পরিণতি শুধুমাত্র মুত্তাকীনদের জন্য নির্ধারিত।

পারিবারিক জীবনে ভরন-পোষণের জণ্য যাবতীয় আয়-রোজগার বৈধ পন্থায় হালাল উপার্জন হতে হবে। হালাল বা বৈধ পন্থায় আয়-রোজগারের জন্য মেহনত করা একটি ফরজ ইবাদাত। মানুষের আয়-রোজগার যখন হালাল হয় এবং হালাল রিজিক দ্বারা রক্ত-মাংস গঠিত হয়, তখন তার হৃদয় ঈমানের নুরে আলোকিত থাকে। পক্ষান্তরে আয়-রোজগার যখন হারাম হয় এবং হারাম রিজিক দ্বারা রক্ত-মাংস গঠিত হয়, তখন তার হৃদয় থেকে ঈমানের নুর বের হয়ে যায়। সুতরাং অবৈধ পন্থায় আয়-রোজগারের সকল উৎস থেকে সর্বদা দুরে থাকতে হবে।

পারিবারিক জীবনে ভরন-পোষণের জণ্য যাবতীয় আয়-রোজগারের দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা পরিবার প্রধান পুরুষের উপর ন্যাস্ত করেছেন। আর মহিলাদেরকে আল্লাহ তায়ালা পরিবারের আভ্যান্তরীন ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পন করেছেন। অবশ্য মহিলাগণ পর্দা সংরক্ষণ করে হালাল পন্থায় পরিবারের মাঝে কিছু আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করতে পারে। যেমন- ঘরে বসে সেলাইয়ের কাজ, ছাত্রীদের টিউশনির মাধ্যমে আয়, হাঁস-মুরগী-কবুতর পালন, ঘরের পাশেই শাক-সবজি চাষ ও ফল-ফলাদি উৎপাদন ইত্যাদি।

অনেক সময় বিধবা মহিলাদের জন্য অর্থ উপার্জন জরুরী হয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই পর্দা সংরক্ষণ করেই উপার্জন করতে হবে। বিধবা, অনাথ এতিমদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করার জন্য তাদের আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, সমাজ ও সমাজপতিদের দায়-দায়িত্ব রয়েছে। তাদের এ দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণে এসব বিধবা, অনাথ এতিমগণ পেটের দায়ে যদি অনৈতিক বা অবৈধ পথে পা বাড়ায়, তাহলে তাদের আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, সমাজ ও সমাজপতিদেরকেও এই পাপের অংশীদার হতে হবে।

হালাল ও পবিত্র জীবিকা পাওয়ার মাধ্যমঃ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ "আর যে আল্লাহ্‌কে ভয় করে, আল্লাহ্ তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন। এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিযিক দেবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্য তিনিই যথেষ্ট।" - (সূরা ত্বালাকঃ আয়াত ২-৩)

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ "হে ঈমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসাবে দান করেছি এবং শুকরিয়া আদায় কর আল্লাহর, যদি তোমরা তাঁরই বন্দেগী কর। তিনি তোমাদের উপর হারাম করেছেন, মৃত জীব, রক্ত, শুকর মাংস এবং সেসব জীব-জন্তু যা আল্লাহ ব্যাতীত অপর কারো নামে উৎসর্গ করা হয়। অবশ্য যে লোক অনন্যোপায় হয়ে পড়ে এবং নাফরমানী ও সীমালঙ্ঘনকারী না হয়, তার জন্য কোন পাপ নেই। নিঃসন্দেহে আল্লাহ মহান ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়ালু।" 
[সূরা বাকারাহঃ আয়াত ১৭২-১৭৩]

তিনি আরও বলেনঃ "হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ। আর তোমরা নিজেদের কাউকে হত্যা করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা তোমাদের প্রতি দয়ালু। আর যে কেউ সীমালঙ্ঘন কিংবা জুলুমের বশবর্তী হয়ে এরূপ করবে, তাকে খুব শীঘ্রই আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। এটা আল্লাহর পক্ষে খুবই সহজসাধ্য।" 
- [সূরা নিসাঃ আয়াত ২৯-৩০]

হযরত জাবের বিন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ "কোন প্রাণী তার নির্দিষ্ট রিযিক পরিপূর্ণরূপে না পাওয়া পর্যন্ত সে মৃত্যু বরণ করবে না। সুতরাং তোমরা আল্লাহ্‌কে ভয় কর এবং রিযিক অনুসন্ধানের জন্য সুন্দর (বৈধ) পন্থা অবলম্বন কর। যা তোমাদের জন্য হালাল করেছেন তা গ্রহণ কর, আর যা হারাম করেছেন তা পরিত্যাগ কর।" 
- (ইবনু মাজাহ, হাকেম ও ইবনু হিব্বান)

হযরত আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ "হে লোক সকল! আল্লাহ পবিত্র,তিনি পবিত্র ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করেন না। আর আল্লাহ মুমীনদেরকে সেই কাজের নির্দেশ দিয়েছেন,যার নির্দেশ পয়গম্বরদেরকে দিয়েছেন। সুতরাং মহান আল্লাহ বলেছেন: হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু হতে আহার কর এবং সৎকর্ম কর - (সূরা মুমিনূন ৫১ আয়াত) তিনি আরও বলেছেন: হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রুযী দিয়েছি তা থেকে পবিত্র বস্তু আহার কর এবং আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর;যদি তোমরা শুধু তাঁরই উপাসনা করে থাক-(সূরা বাকারাহ ১৭২ আয়াত) অতঃপর তিনি সেই লোকের কথা উল্লেখ করে বললেন, যে এলোমেলো চুলে, ধূলামলিন পায়ে সুদীর্ঘ সফরে থেকে আকাশ পানে দুহাত তুলে ইয়া রব! ইয়া রব! বলে দোআ করে। অথচ তার খাদ্য হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম এবং হারাম বস্তু দিয়েই তার শরীর পুষ্ট হয়েছে। তবে তার দোআ কিভাবে কবুল করা হবে? " - (সহীহ মুসলিম)

ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা, রাহাজানী-ছিনতাই, চুরি-ডাকাতি, জুয়া-লটারীর, অবৈধ পেশা (যেমন- নাচ, গান, অভিনয়, জীব-জন্তুর ছবি অংকন, মুর্তি-মুরাল-প্রতিকৃতি তৈরী, যৌনসেবা ইত্যাদি), অবৈধ চাকুরি, অবৈধ ব্যবসা (যেমন- মদের ব্যবসা, সিনেমার ব্যবসা), অবৈধ ব্যবসার শেয়ার, সুদ ভিত্তিক ব্যবসার শেয়ার ইত্যাদির মাধ্যমে যিনি প্রচুর অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন তার উপার্জিত অর্থ হারাম। হারাম অর্থে দেহের যখন পুষ্টি সাধিত হয় তার ইবাদাত ও প্রার্থনা আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য নয়, জাহান্নামই তার উপযুক্ত স্থান

ব্যবসা বানিজ্যে সততার ফজিলতঃ হযরত আবু খালিদ হাকিম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ক্রেতা ও বিক্রেতা একে অপর থেকে পৃথক না হওয়া পর্যন্ত তাদের কেনা-বেচা বাতিল করার অধিকার রাখেযদি তারা উভয়ে সত্য পথে থাকে, তাহলে তাদের কেনা-বেচায় বরকত হয়আর যদি মিথ্যার আশ্রয় নেয়, তাহলে তাতে বরকত নষ্ট করে দেওয়া হয় - (বুখারী ও মুসলিম)

হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ "ব্যবসায়ে মিথ্যা শপথে হয়ত বেশী পণ্য বিক্রয় হতে পারে, কিন্তু তা উপার্জনের বরকত নষ্ট করে দেয়।" 
-( বুখারী ও মুসলিম)

অন্যায়ভাবে অপরের অধিকার হরণের পরণামঃ হযরত আবু উমামা ইয়াস ইবনে সালাবা আল-হারিসী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ "যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথ করে কোন মুসলমানের সামান্যতম অধিকার বা মালিকানা বা সম্মান আত্মসাৎ করল, আল্লাহ তাঁর জন্য দোযখ অবশ্যম্ভাবী করে দেন এবং বেহেশত হারাম করে দেন।" -(মুসলিম)

হযরত আবূ সালামা বর্ণনা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, "তার ও কিছু লোকের মধ্যে জমি-জমা নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ ছিল। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা - এর কাছে ব্যাপারটি উল্লেখ করা হলে তিনি বলেন, হে আবূ সালামা! জমি নিয়ে বিবাদ-বিসম্বাদ হতে আত্নরক্ষা করে চল। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি এক আংগুল পরিমাণ জমি অন্যায়ভাবে কেড়ে নিবে কিয়ামতের দিনে সাত তবক জমির বেষ্টনি তার গলায় পরিয়ে দেয়া হবে।" -(বুখারিঃ হাদীসঃ নং- ২৪৫৩)

হযরত আবূ উসামাহ ইবনে সালাবা হারেসী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ "যে ব্যক্তি (মিথ্যা) কসম খেয়ে কোন মুসলমানের হক মেরে নেবে, তার জন্য আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম ওয়াজিব এবং জান্নাত হারাম করে দেবেন। একটি লোক বলল, যদি তা নগণ্য জিনিস হয় হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, যদিও তা পিল্লু গাছের একটি ডালও হয়।" -(মুসলিমঃ ১৩৭, নাসায়ীঃ ৫৪১৯, ইবনু মাজাহঃ ২৩২৪, মুসনাদে আহমাদঃ ২১৭৩৬, মুয়াত্তা মালেকঃ ১৮৩৫, দারেমীঃ ১৬০৩)

যে সব উপার্জন হারামঃ হযরত আবু মাসঊদ আল-বদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুকুরের মূল্য, দেহ ব্যবসার উপার্জন ও গণকের পারিশ্রমিক হারাম করেছেন। -(বুখারী ও মুসলিম) 

হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: "যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রতি কোন অন্যায় করেছে, অথবা তার সম্মানহানী করেছে কিংবা অন্যকোনভাবে তার ক্ষতি করেছে সে যেন যেদিন কোন টাকা-পয়সা কাজে আসবে না সে দিন আসার পূর্বে আজই (দুনিয়াতে থাকাবস্থায়) তার প্রতিকার করে নেয়। কেয়ামতের বিচারে অন্যায়কারীর কোন নেক আমল থাকলে তা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পাওনা আদায় করা হবে। আর যদি অন্যায়কারীর নেক আমল না থাকে তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পাপগুলো তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে।" -(বুখারী)

হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: তোমরা কি জান দরিদ্র অসহায় ব্যক্তি কে? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমাদের মধ্যে দরিদ্র অসহায় ব্যক্তিতো সে যার কোন টাকা পয়সা বা সম্পদ নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: আমার উম্মতের মধ্যে সত্যিকার দরিদ্র অসহায় হলো সেই ব্যক্তি যে কেয়ামতের দিন সালাত, সিয়াম ও যাকাতসহ অনেক ভাল কাজ নিয়ে উপস্থিত হবে, অথচ দুনিয়াতে বসে সে কাউকে গালি দিয়েছিল, কারো প্রতি অপবাদ দিয়েছিল, করো সম্পদ আত্নসাত করেছিল, কারো রক্তপাত ঘটিয়েছিল, কাউকে মারধোর করেছিল ফলে তার নেক আমলগুলো থেকে নিয়ে তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পাওনা আদায় করা হবে। এভাবে যখন তার নেক আমলগুলো শেষ হয়ে যাবে ক্ষতিগ্রস্তদের দেয়ার জন্য আর কিছু থাকবে না তখন তাদের পাপগুলো তাকে দেয়া হবে ফলে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। -(মুসলিমঃ ২৫৮১; তিরমিযীঃ ২৪১৮; আহমাদঃ ৭৯৬৯, ৮২০৯, ৮৬২৫)

পরিতাপের বিষয়! মুসলিম উম্মাহর মাঝে যারা প্রচুর বিত্ত-ভৈববের মালিক, তাদের অধিকাংশের অর্থসম্পদ হারাম পথে অর্জিত। আল্লাহ তায়ালার দরবারে মুসলিম হিসাবে গণ্য হতে চাইলে সমস্ত হারাম উপার্জনের সকল পথ পরিহার করতে হবে। এ ব্যপারে সবাইকে সচেতন ও সতর্ক করতে হবে।


মৃত্যের পরিত্যাক্ত সম্পদে নারী-পুরুষ ওয়ারিসদের অধিকার


মৃত্যের পরিত্যাক্ত সম্পদে নারী-পুরুষ ওয়ারিসদের অধিকার
ডাঃ গাজী মোঃ নজরুল ইসলাম

পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়গণের ত্যাজ্য সম্পত্তিতে আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত বিধান মোতাবেক পরিবারের অন্তর্গত নারী-পুরুষ ওয়ারিসদের অধিকার রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের অধিকার সমান নয়, বরং পার্থক্য রয়েছে। এ ব্যাপারে নারী ও পুরুষের অধিকার সমান করা বা, আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত বিধানের চেয়ে কম-বেশী করা বা কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না। তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অবাধ্যতা এবং সীমা লংঘন করার কারণে জাহান্নামে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। এ প্রসংগে আল্লাহ তায়ালা ঘোষনা করেনঃ

لِّلرِّجَالِ نَصيِبٌ مِّمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالأَقْرَبُونَ وَلِلنِّسَاء نَصِيبٌ مِّمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالأَقْرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ أَوْ كَثُرَ نَصِيبًا مَّفْرُوضًا

- পিতা-মাতা ও আত্নীয়-স্বজনদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষদেরও অংশ আছে এবং পিতা-মাতা ও আত্নীয়-স্বজনদের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীদেরও অংশ আছে; অল্প হোক কিংবা বেশী। এ অংশ নির্ধারিত। - (সূরা আন নিসাঃ ৭) তিনি আরও বলেনঃ

وَلِكُلٍّ جَعَلْنَا مَوَالِيَ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالأَقْرَبُونَ وَالَّذِينَ عَقَدَتْ أَيْمَانُكُمْ فَآتُوهُمْ نَصِيبَهُمْ إِنَّ اللّهَ كَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدًا

- “পিতা-মাতা এবং নিকটাত্নীয়গণ যা ত্যাগ করে যান সেসবের জন্যই আমি ওয়ারিস নির্ধারণ করে দিয়েছি। আর যাদের সাথে তোমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছ তাদের প্রাপ্য দিয়ে দাও। আল্লাহ তাআলা নিঃসন্দেহে সব কিছুই প্রত্যক্ষ করেন।“ -[সূরা নিসাঃ আয়াত ৩৩] তিনি আরও বলেনঃ

يُوصِيكُمُ اللّهُ فِي أَوْلاَدِكُمْ لِلذَّكَرِ مِثْلُ حَظِّ الأُنثَيَيْنِ فَإِن كُنَّ نِسَاء فَوْقَ اثْنَتَيْنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَكَ وَإِن كَانَتْ وَاحِدَةً فَلَهَا النِّصْفُ وَلأَبَوَيْهِ لِكُلِّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَكَ إِن كَانَ لَهُ وَلَدٌ فَإِن لَّمْ يَكُن لَّهُ وَلَدٌ وَوَرِثَهُ أَبَوَاهُ فَلأُمِّهِ الثُّلُثُ فَإِن كَانَ لَهُ إِخْوَةٌ فَلأُمِّهِ السُّدُسُ مِن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصِي بِهَا أَوْ دَيْنٍ آبَآؤُكُمْ وَأَبناؤُكُمْ لاَ تَدْرُونَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ لَكُمْ نَفْعاً فَرِيضَةً مِّنَ اللّهِ إِنَّ اللّهَ كَانَ عَلِيما حَكِيمً

- আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে আদেশ করেনঃ একজন পুরুষের অংশ দুজন নারীর অংশের সমান। অতঃপর যদি শুধু নারীই হয় দুই এর অধিক, তবে তাদের জন্যে ঐ সম্পদের তিন ভাগের দুই ভাগ যা ত্যাগ করে মরে এবং যদি একজনই হয়, তবে তার জন্যে অর্ধেক। মৃতের পিতা-মাতার মধ্য থেকে প্রত্যেকের জন্যে ত্যাজ্য সম্পত্তির ছয় ভাগের এক ভাগ, যদি মৃতের পুত্র থাকে। যদি পুত্র না থাকে এবং পিতা-মাতাই ওয়ারিস হয়, তবে মাতা পাবে তিন ভাগের এক ভাগ। অতঃপর যদি মৃতের কয়েকজন ভাই থাকে, তবে তার মাতা পাবে ছয় ভাগের এক ভাগ ওছিয়্যতের পর, কিংবা ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের পিতা ও পুত্রের মধ্যে কে তোমাদের জন্যে অধিক উপকারী তোমরা জান না। এটা আল্লাহ কতৃক নির্ধারিত অংশ নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, রহস্যবিদ। - (সূরা আন-নিসাঃ আয়াত ১১)

وَلَكُمْ نِصْفُ مَا تَرَكَ أَزْوَاجُكُمْ إِن لَّمْ يَكُن لَّهُنَّ وَلَدٌ فَإِن كَانَ لَهُنَّ وَلَدٌ فَلَكُمُ الرُّبُعُ مِمَّا تَرَكْنَ مِن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصِينَ بِهَا أَوْ دَيْنٍ وَلَهُنَّ الرُّبُعُ مِمَّا تَرَكْتُمْ إِن لَّمْ يَكُن لَّكُمْ وَلَدٌ فَإِن كَانَ لَكُمْ وَلَدٌ فَلَهُنَّ الثُّمُنُ مِمَّا تَرَكْتُم مِّن بَعْدِ وَصِيَّةٍ تُوصُونَ بِهَا أَوْ دَيْنٍ وَإِن كَانَ رَجُلٌ يُورَثُ كَلاَلَةً أَو امْرَأَةٌ وَلَهُ أَخٌ أَوْ أُخْتٌ فَلِكُلِّ وَاحِدٍ مِّنْهُمَا السُّدُسُ فَإِن كَانُوَاْ أَكْثَرَ مِن ذَلِكَ فَهُمْ شُرَكَاء فِي الثُّلُثِ مِن بَعْدِ وَصِيَّةٍ يُوصَى بِهَآ أَوْ دَيْنٍ غَيْرَ مُضَآرٍّ وَصِيَّةً مِّنَ اللّهِ وَاللّهُ عَلِيمٌ حَلِيمٌ

- আর, তোমাদের হবে অর্ধেক সম্পত্তি, যা ছেড়ে যায় তোমাদের স্ত্রীরা যদি তাদের সন্তান না থাকে। যদি তাদের সন্তান থাকে, তবে তোমাদের হবে এক-চতুর্থাংশ ঐ সম্পত্তির, যা তারা ছেড়ে যায়; ওছিয়্যতের পর, যা তারা করে এবং ঋণ পরিশোধের পর। স্ত্রীদের জন্যে এক-চতুর্থাংশ হবে ঐ সম্পত্তির, যা তোমরা ছেড়ে যাও যদি তোমাদের কোন সন্তান না থাকে। আর যদি তোমাদের সন্তান থাকে, তবে তাদের জন্যে হবে ঐ সম্পত্তির আট ভাগের এক ভাগ, যা তোমরা ছেড়ে যাও ওছিয়্যতের পর, যা তোমরা কর এবং ঋণ পরিশোধের পর। যে পুরুষের, ত্যাজ্য সম্পত্তি, তার যদি পিতা-পুত্র কিংবা স্ত্রী না থাকে এবং এই মৃতের এক ভাই কিংবা এক বোন থাকে, তবে উভয়ের প্রত্যেকে ছয়-ভাগের এক পাবে। আর যদি ততোধিক থাকে, তবে তারা এক তৃতীয়াংশ অংশীদার হবে ওছিয়্যতের পর, যা করা হয় অথবা ঋণের পর এমতাবস্থায় যে, অপরের ক্ষতি না করে। এ বিধান আল্লাহর। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সহনশীল। -(সূরা আন-নিসাঃ আয়াত ১২)

ِلْكَ حُدُودُ اللّهِ وَمَن يُطِعِ اللّهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
وَمَن يَعْصِ اللّهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُّهِينٌ

- এগুলো আলাহর নির্ধারিত সীমা। যে কেহ আল্লাহ ও তার রসুলের আদেশমত চলে, তিনি তাকে জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশ দিয়ে স্রোতস্বিনী প্রবাহিত। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে আর এ হল বিরাট সফলতা। আর যে কেহ আল্লাহ ও তার রসূলের অবধ্যতা করে এবং সীমা অতিক্রম করে, তিনি তাকে জলন্ত আগুনে প্রবেশ করাবেন। সেখানে সে চিরকাল থাকবে। আর তার জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি। -(সূরা আন-নিসাঃ আয়াত ১৩-১৪)


আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে তাঁর কল্যাণময় বিধান অনুধাবন করার এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে 
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, খুলাফায়ে রাশিদীন, রসূলের বংশধর ও সাহাবা (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-গনের আদর্শের  মেনে চলার তৌফিক দান করুন! -মী-ন।

পরিবার গঠন ও বিবাহ সংক্রান্ত ইসলামী নীতিমালা


পরিবার গঠন ও বিবাহ সংক্রান্ত ইসলামী নীতিমালা
ডাঃ গাজী মোঃ নজরুল ইসলাম

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা'য়ালার জন্য- যিনি রব্বুল আ'লামীন। দুরদ ও সালাম রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি যিনি রহমাতুল্লিল আ'লামীন, তাঁর পরিবারবর্গ ও বংশধর, সাহাবায়ে কিরাম (রাদিআল্লাহু আনহুম) ও সালিহীন (র) বান্দাগণের প্রতি। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই এবং মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর বান্দা ও তার রসুল। নিশ্চয়ই শুভ পরিণতি কেবলমাত্র মুত্তাকীনদের জন্যই নির্ধারিত।

বিবাহের মাধ্যমেই মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশঃ এপসংগে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন: “হে মানবজাতি, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক তাকওয়াসম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন” -[আল কুরআনসূরা হুজুরাত, আয়াত ১৩]

নারী-পুরুষ সৃষ্টি মহান আল্লাহ তা’য়ালার অন্যতম অনুপম নিদর্শনঃ এ প্রসংগে তিনি বলেন: তাঁর (আল্লাহর) অন্যতম একটি নিদর্শন যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।-(সূরা রোম: আয়াত ২১)

যারা বিবাহে সামর্থ নয়, তারা যেন সংযম অবলম্বন করেঃ এ প্রসংগে তিনি বলেন: “যারা বিবাহে সামর্থ নয়, তারা যেন সংযম অবলম্বন করে যে পর্যন্ত না আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেন। তোমাদের অধিকারভুক্তদের মধ্যে যারা মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তি করতে চায়, তাদের সাথে তোমরা লিখিত চুক্তি কর যদি জান যে, তাদের মধ্যে কল্যাণ আছে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে, অর্থ-কড়ি দিয়েছেন, তা থেকে তাদেরকে দান কর। তোমাদের দাসীরা নিজেদের পবিত্রতা রক্ষা করতে চাইলে তোমরা পার্থিব জীবনের সম্পদের লালসায় তাদেরকে ব্যভিচারে বাধ্য কারো না। যদি কেহ তাদের উপর জোর-জবরদস্তি করে, তবে তাদের উপর জোর-জবরদস্তির পর আল্লাহ তাদের প্রতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু -[সূরা আন-নূরঃ আয়াত ৩৩]

বিবাহের মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহে আর্থিক সচ্ছলতা আসেঃ এ প্রসংগে তিনি বলেন : "তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত , তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ”-(সূরা নুরঃ আয়াত ৩২)

দাম্পত্য জীবনে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী একে অপরের অভিভাবক ও বন্ধুঃ এ প্রসংগে তিনি বলেন: “মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী একে অপরের অভিভাবক ও বন্ধু। তারা ভাল কাজের আদেশ দেয়, খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে, সালাত কায়িম করে, যাকাত আদায় করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। আল্লাহ তাদের প্রতি অচিরেই রহমত নাযিল করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রশালী, মহাপ্রজ্ঞাময়। আল্লাহ মুমিন পুরুষ ও নারীদের জন্য এমন জান্নাতের অঙ্গীকার করেছেন যে জান্নাতের নিচ দিয়ে ঝর্ণাসমূহ বয়ে যায়। সেখানে তারা চিরদিন থাকবে। আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেন মহাপবিত্র স্থায়ী বাসস্থান আদন নামক জান্নাতের। বস্তুত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং এটাই সবচেয়ে বড় সফলতা”- (সূরা তওবাঃ আয়াত ৭১-৭২)

হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য মুশরিকদের সাথে বিবাহ বন্ধন আল্লাহ তা’য়ালা বলেন : "মুমিন না হওয়া পর্যন্ত কোন মুশরিক নারীকে বিয়ে কর না, যদিও সে তোমাদেরকে মুগ্ধ করে; মুশরিক নারীর চেয়ে মুমিন দাসীরা উত্তম। আর তোমরা মুশরিক পুরুষকে বিয়ে কর না যতণ না তারা ঈমান আনে, যদিও সে তোমাদেরকে মুগ্ধ করে; মুমিন দাস তাদের চেয়ে উত্তম। মুশরিক নারী ও পুরুষ তোমাদেরকে জাহান্নামের দিকে ডাকে আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তোমাদেরকে জান্নাত ও মার প্রতি আহ্বান করেন। তিনি মানুষের জন্য তাঁর বিধানসমূহ সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করেন, যেন তারা তা স্মরণ রাখে ও মেনে চলে।" - (সূরা বাকারাহ : আয়াত-২২১)

ইয়াহুদী-খৃষ্টানদের সাথে বিবাহ বন্ধন সমাজে কতিপয় লোককে ইয়াহুদী-খৃষ্টানদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে দেখা যায়। অথচ তাদের কুফরী, শিরকী ও আল্লাহর মনোনীত দ্বীনের সুস্পষ্ট বিরোধিতা প্রসংগে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন : ইয়াহুদীরা বলে- উযায়র আল্লাহর পুত্র।খৃষ্টানরা বলে: মসীহ আল্লাহর পুত্র।এটা কেবলই তাদের মুখের অবাস্তব কথা। ইয়াহুদী-খৃষ্টানরা তাদেরই মত কথা বলে যারা তাদের আগে কুফরি করেছিল। আল্লাহ তাদের ধ্বংস করুন, তারা উল্টো কোন দিকে যাচ্ছে? আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা তাদের জ্ঞানী ব্যক্তিদের ও ধর্মযাজকদেরকে এবং মারইয়াম পুত্র মসীহকে প্রতিপালক হিসেবে গ্রহণ করেছে। অথচ তারা একমাত্র ইলাহ আল্লাহর ইবাদাত করার জন্য আদিষ্ট হয়েছিল। আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তারা যাকে (আল্লাহর) শরীক সাব্যস্ত করে তা হতে তিনি পবিত্র। তারা তাদের মুখের ফুঁৎকার দিয়ে আল্লাহর নূর নিভিয়ে দিতে চায়। কিন্তু কাফিরদের অপছন্দ হলেও আল্লাহ তাআলা তাঁর নূরকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করা ছাড়া আর কিছু চান না। সকল দীনের উপর সুপ্রকাশিত ও জয়যুক্ত করার জন্য আল্লাহ তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সঠিক দীনসহ প্রেরণ করেছেন, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে। -( সূরা তওবা : আয়াত ৩০-৩৩)

মুসলিম নামধারী মুশরিক ও তাগুতের সাথে বিবাহ বন্ধনঃ মুসলিম সমাজের মাঝে যারা মুসলিম নামধারী হয়েও বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিরক, কুফর, নিফাক ও তাগুতের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে বা জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর সুমহান আদর্শের বিরোধিতায় লিপ্ত রয়েছে বা সমাজ ও সভ্যতার বিনির্মানে এবং আইন ও বিধি-বিধান পালনে কুরআন ও সুন্নাহকে অচল বলে পিছনে ফেলে রেখেছে-তারাও আল্লাহর দরবারে মুশরিক হসাবেই গণ্য। খাটি তওবা না করা পর্যন্ত তাদের সাথে কোন মুমীন নর-নারীর বিবাহ বৈধ নয়।

প্রকাশ্য ব্যভিচারে লিপ্ত ও চরিত্রহীনদের খাটি মুমীন নর-নারীর বিবাহ বৈধ নয়ঃ এ প্রসংগে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন: “ব্যভিচারী পুরুষ কেবল ব্যভিচারিণী নারী অথবা মুশরিকা নারীকেই বিয়ে করে এবং ব্যভিচারিণীকে কেবল ব্যভিচারী অথবা মুশরিক পুরুষই বিয়ে করে এবং এদেরকে মুমিনদের জন্যে হারাম করা হয়েছে”-(সূরা আন- নুর, আয়াতঃ ৩)

তিনি আরও বলেন : “দুশ্চরিত্রা মহিলারা দুশ্চরিত্র পুরুষদের জন্য এবং দুশ্চরিত্র পুরুষরা দুশ্চরিত্রা মহিলাদের জন্য। সচ্চরিত্রা মহিলারা সচ্চরিত্র পুরুষদের জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষরা সচ্চরিত্রা মহিলাদের জন্য । লোকে যা বলে তা থেকে তারা পূত-পবিত্র। তাদের জন্য রয়েছে মাগফিরাত ও মর্যাদাপূর্ণ জীবিকা।” -(সুরা নুর: আয়াত ২৬)

বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর দ্বীনদারীকেই গুরুত্ব দিতে হবেঃ হযরত আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : চারটি বিষয় বিবেচনা করে কোন মেয়েকে বিবাহ করা হয়- (১) তার ধন-সম্পদ, (২) তার বংশ-মর্যাদা, (৩) তার রূপ-সৌন্দর্য্য ও (৪) তার ধর্ম-পরায়ণতা। এর মধ্যে ধর্মপরায়ণ স্ত্রী লাভে তুমি সফলকাম হও। তোমার হাত কল্যাণে ভরপুর হবে। -(বুখারী ও মুসলিম)

বিবাহের ফায়দাঃ হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ হে যুবকরা! তোমাদের কেউ বিবাহ করতে সক্ষম হলে সে যেন দ্রুত বিবাহ করে নেয়। কারন,তা চুক্ষুকে নিম্নগামী করে ও লজ্জাস্থান কে করে পবিত্র। আর যে ব্যক্তি বিবাহ করতে সক্ষম নয় সে যেন রোযা রাখে। কারন,তা সত্যি যৌন উত্তেজনা প্রশমনকারী। -(বুখারিঃ হাদিস-৫০৬৫ ও মুসলিমঃ হাদিস-১৪০০)

বিবাহের মাধ্যমে পারিবারিক জীবনের দায়িত্ব অর্পিত হয়ঃ হযরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি : তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককে তার অধীনস্তদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আমির বা শাসক তার অধীনস্থ লোকদের দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ব্যক্তি তার পরিবার পরিজনের দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীর সংসারের দায়িত্বশীল, তাকে তার দায়িত্ব পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। খাদেম তার মনিবের ধন- সম্পদের হেফাজতকারী, তাকে তার দায়িত্ব পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। কাজেই তোমরা সবাই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককে তার দায়িত্ব পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।  -(বুখারী ও মুসলিম)

আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সবাইকে বিবাহের মুলনীতিসমূহ আরও বিস্তারিতভাবে জানার, উপলব্ধি করার ও অনুসরণ করার মাধ্যমে মহান আল্লাহ তা’য়ালার সন্তোষ মোতাবেক সুমধুর ও কল্যাণময় পারিবারিক জীবন গঠন করার তৌফিক দান করুন! আ-মীন।