আল্লাহর মহব্বত অর্জনের জন্য সাধনার স্তর
আল্লাহর নৈকট্য, সন্তোষ ও মহব্বত অর্জনের
জন্য তার মাকবুল বান্দাগণকে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়। সাধনার পথের পথিককে অবশ্যই পথের চড়াই-উৎড়াই, সমস্যা ও সম্ভাবনা, পরীক্ষা ও পুরস্কার
ইত্যাদি বিষয়ে মৌলিক ধারণা থাকতে হবে। মহাসমুদ্র পাড়ি দেয়ার জন্য যেমন কম্পাস, জাহাজ ও ক্যাপ্টেন প্রয়োজন তেমনি সাধনার মহাসমুদ্র পথের
কম্পাস হল কুরআন ও ছুন্নাহ, জাহাজ হল ইসলাম আর ক্যাপ্টেন হল
রসূলের ওয়ারিস হক্কানী ওলামা, মুর্শিদ বা শাইখ- যাদের
জীবনাচারে ছুন্নাতের প্রতিফলন রয়েছে।
হযরত আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
এরশাদ করেছেন : আল্লাহ তা'য়ালা বলেন : যে ব্যক্তি
আমার কোন বন্ধুর সাথে দুশমনী পোষণ করে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করি। বান্দারা যে সব আমল দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করে এর মধ্যে ফরজ আমল সমুহ আমার
নিকট অধিক প্রিয়। বান্দা যখন নফল আমলের মাধ্যমে আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকবে তখন আমিও তাকে
ভালবাসব। যখন আমি তাকে ভালবাসি তখন আমি তার কান হয়ে যাই যা দ্বারা সে শোনে, চোখ হয়ে যাই যা দ্বারা সে দেখে,
হাত হয়ে যাই যা দ্বারা সে ধরে, পা হয়ে যাই যা
দ্বারা সে চলে। যদি সে আমার নিকট কিছু প্রার্থনা করে তবে
অবশ্যই তাকে তা দান করি। আর যা থেকে বাচঁতে চায় তা থেকে বাচাঁই। আমি কোন কাজ করতে দ্বিধা করি না, শুধু ঐ মু’মীন বান্দার রূহ কবজ ছাড়া। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে এবং আমিও তার অনিচ্ছায় জোর করতে চাই না, অথচ তাকে মরতে হবে। -(ইমাম বুখারী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)
আল্লাহ তা'য়ালার সন্তোষ ও মহব্বত
অর্জনের জন্য সাধনার পথে বহু স্তর রয়েছে। এ পথের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর সম্পর্কে মৌলিক ধারণা থাকা সাধকের জন্য
একান্ত প্রয়োজন। কিছু স্তরের আলোচনা পেশ করা হল।
০ মু'মিনীনের স্তরঃ
আল্লাহ তা'য়ালার নৈকট্য অর্জনের
সর্বপ্রথম ও সর্বনিম্ন স্তর হল মু’মিনীনের স্তর। আল্লাহ তা'য়ালার কোন বান্দা যখন অটল
বিশ্বাসের সংগে ঘোষণা করেন : ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু
মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রসূল’ তখন তিনি মু’মিনীনের স্তরে দাখিল হবেন। বিশুদ্ধ ঈমান হবে শিরকমুক্ত, তাগুতমুক্ত, নিফাকমুক্ত,
জাহিলিয়াতমুক্ত ও কুফরমুক্ত। মু’মিনীনের স্তরে বহাল থাকতে
হলে উক্ত ঘোষণার পরিপন্থী কোন আকিদা ও আমলের সাথে সম্পর্ক রাখা যাবে না। তাহলে তিনি মু’মিনীনের স্তর থেকে খারিজ
হয়ে যাবেন। তার ইমান ও আমল কোন কিছুই কবুল হবে না।
রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ঈমান হল আল্লাহর প্রতি, তার ফিরিশতাগণের প্রতি, তার কিতাবসমুহের প্রতি, তার রসূলগণের প্রতি, পরকালের প্রতি এবং তাকদিরের ভালমন্দের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা। (ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)
মুমিনীনের স্তরে বহাল থাকতে হলে ঈমান হতে হবে শিরক মুক্ত। ঈমানের ঘোষণার পর যদি কেউ একটিমাত্র শিরকও করে তাহলে তিনি ঈমান থেকে খারিজ হয়ে
যাবেন। আল্লাহ তার এই ঈমান ও কোন আমল কবুল করবেন না। এ প্রসংগে আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর বান্দাগণকে
সতর্ক করে দিয়ে বলেন : ..... যদি তুমি কোন শিরক কর, তাহলে তোমার সমস্ত আমল বাতিল হয়ে যাবে, আর অবশ্যই
তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে। (সূরা যুমার : ৬৫)
তিনি আরও বলেন : যারা ঈমান আনবে এবং এর সাথে কোন প্রকার জুলুম
(শিরক) মিশ্রিত করবে না, তাদের জন্য রয়েছে নিরাপত্তা আর
তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত। (সূরা আনআম : ৮২)
তিনি আরও বলেন : আর যে
আল্লাহর সাথে শরীক করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে
দেন আর তার চিরস্থায়ী ঠিকানা হবে জাহান্নাম। আর ঐ সমস্ত জালিমদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না। (সূরা মায়েদা : ৭২)
মুমিনীনের স্তরে বহাল থাকতে হলে ঈমান হতে হবে তাগুত মুক্ত বিশুদ্ধ ঈমান। তাগুত হল ঐ সমস্ত নাফ্স, পরিবার প্রধান, ভন্ড ধর্মনেতা, সমাজপতি, রাষ্ট্রনায়ক -বিধায়ক-বিচারক-প্রশাসক;
যারা আল্লাহ ও তার রসূলের আনুগত্যের পরিবর্তে লোকদেরকে
স্বেচ্ছাচারিতা, ধর্মের নামে অধর্ম-কুসংস্কার, পূর্বপুরুষদের প্রচলিত রসম-কুপ্রথা-জাহিলিয়াত, শিরক-মুর্তিপুজা
ও মানব রচিত তন্ত্র-মন্ত্র-আইন-বিধি-বিধানের আনুগত্য করতে বাধ্য করে। সর্বযুগে সমস্ত জনপদে আল্লাহর প্রেরিত অসংখ্য নবী-রসূলগণ (আ) সব ধরনের
তাগুতসমূহ পরিত্যাগ করে কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করার জন্য মানব জাতিকে আহ্বান
জানিয়েছেন। যুগে যুগে নবী-রসূল (আ) প্রেরণের উদ্দেশ্য প্রসংগে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
-নিশ্চয়ই আমি প্রত্যেক উম্মাতের নিকট এ মর্মে রসূল প্রেরণ করেছি
যে, তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুতকে অস্বীকার কর। (সূরা নহল : ৩৬)
আল্লাহর গোলামী ও তাগুতের গোলামী সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। তাগুতদেরকে অস্বীকার, বর্জন ও অমান্য করে তাদের
গোলামী থেকে মুক্ত হয়ে একমাত্র আল্লাহর উপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন এবং
কেবলমাত্র আল্লাহমুখী হয়ে তার গোলামী মনে-প্রাণে মেনে নেয়াই হল প্রকৃত ঈমান। এ প্রসংগে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
-দ্বীন ইসলামের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই। সুপথ গোমরাহীর পথ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। অতঃপর যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে এমন এক মজবুত হাতল ধারণ করবে,
যা কখনও বিচ্ছিন্ন হবে না। আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও মহাজ্ঞানী। (সূরা বাকারাহ : ২৫৬)
তিনি আরও বলেন : যারা তাগুতের দাসত্ব থেকে দুরে থাকে এবং
আল্লাহর অভিমুখী হয়, তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ, অতএব আমার বান্দাগণকে সুসংবাদ দিন। (সূরা যুমার : ১৭)
মুমিনীনের স্তরে কায়েম থাকতে হলে ঈমান হতে হবে নিফাক মুক্ত বিশুদ্ধ ঈমান। আল্লাহর পথ ও তাগুতের পথ সম্পূর্ণ বিপরীত বিধায় উভয়ের সাথে সম্পর্ক রাখা হল-
নিফাক। মুনাফিকদের পরিচয় প্রসংগে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
- আর মানব জাতির মাঝে এমন কিছু লোক আছে যারা বলে, “আমরা আল্লাহ ও আখিরাতের দিবসের
প্রতি ঈমান এনেছি” কিন্তু আসলে তারা মু’মিন নয়। তারা আল্লাহ ও মু’মিনগণকে প্রতারিত করতে চায়, আসলে তারা যে শুধু নিজেদেরকেই প্রতারিত করছে, অন্য কাউকে নয়, এটাও তারা বুঝতে পারছে
না। তাদের অন্তরে ব্যধি রয়েছে, আল্লাহ তাদের (অবিরাম অপরাধের কারণে) সেই ব্যাধিকে আরও বৃদ্ধি করেছেন। আর তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে, কারণ তারা মিথ্যা বলত। আর যখন তাদেরকে বলা হয়, “তোমরা দুনিয়ায় অশান্তি সৃষ্টি করো না” তখন তারা বলে,
“আমরা তো শান্তি স্থাপনকারী”। সাবধান! এরাই অশান্তি সৃষ্টিকারী কিন্তু এরা তা বোঝে না। আর যখন তাদেরকে বলা হয়, “অন্যান্য মানুষ
(সাহাবাগণ) যেমন ঈমান এনেছে, তোমরাও তাদের মত ঈমান আন”
তখন তারা বলে, “নির্বোধগণ যেরূপ ঈমান এনেছে
আমরাও কি সেরূপ ঈমান আনব?” সাবধান! এরাই আসলে নির্বোধ,
কিন্তু এরা তা জানে না। যখন তারা মুমিনদের সাথে থাকে তখন তারা বলে, “আমরা ঈমান এনেছি”। আর যখন তারা গোপনে তাদের শয়তান সঙ্গীদের সাথে থাকে, তখন বলে, “নিশ্চয়ই
আমরা তোমাদের সাথেই আছি। নিশ্চয়ই আমরা তাদের সাথে কেবল ঠাট্টা-তামাশাই করে থাকি”। আল্লাহ তাদের ঠাট্টার পরিণাম যথাযথভাবে দিয়ে থাকেন এবং তাদেরকে অবাধ্যতার
মধ্যে পথহারাদের মত ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ দেন। তারা সেই লোক যারা হিদায়াতের বিনিময়ে
গুমরাহী বেছে নিয়েছে । কিন্তু তাদের এ ব্যবসা লাভজনক হয়নি এবং
তারা সুপথে পরিচালিত নয়।- (সূরা বাকারাহ : ৮-১৬)
মুমিনীনের স্তরে কায়েম থাকতে হলে ঈমান হতে হবে কুফরমুক্ত। আল্লাহ তা'য়ালার কোন বান্দা যখন
ঘোষণা করেন- আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তখন আল্লাহর সমস্ত
হুকুম মেনে নেয়া তার জন্য বাধ্যতামুলক হয়ে যায়। আর যখন ঘোষণা করেন- মুহাম্মাদ (স) আল্লাহর বান্দা ও রসূল, তখন রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ মেনে নেয়াও বাধ্যতামুলক হয়ে যায়।
আল্লাহকে ইলাহ এবং মুহাম্মাদ (স) কে রসূল হিসাবে মেনে নেয়ার পর আল্লাহর কোন
হুকুম পালন করতে বা রসূলের কোন আদর্শ মেনে চলতে কোন ওজর বশতঃ অপারগ হলে তিনি
গুণাহগার হবেন কিন্তু ঈমান থেকে খারিজ হবেন না। আল্লাহ ইচ্ছা করলে মেহেরবানী করতঃ বান্দার ওজর কবুল করে মা করে দিতে পারেন বা
ইনসাফ করতঃ গোণাহের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি দিতে পারেন।
কিন্তু আল্লাহর কোন একটি বিধান বা রসূলের কোন একটি নীতি ও আদর্শ মেনে নিতে
অস্বীকার বা ইনকার করলে কিম্বা তার তুলনায় অন্য কোন বিধি-বিধান, আইন, নীতি ও
আদর্শকে উত্তম মনে করলে তিনি ঈমান থেকে খারিজ হয়ে কাফির হয়ে যাবেন, অথচ অনেকেই তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন না।
পবিত্র কুরআন ও সহীহ্ হাদীসসমূহে খাঁটি মু’মিনীনদের অনেক গুণাবলীর কথা বর্ণনা করা হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ- আল্লাহ তায়ালা বলেন :
- নিশ্চয়ই মু’মিন তারা- আল্লাহর নাম
উচ্চারিত হলে যাদের হৃদয় বিগলিত হয়ে চমকে ওঠে, যখন তাদের
নিকট আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তাদের ঈমানকে সুদৃঢ় করে আর তারা কেবলমাত্র
তাদের প্রভুর উপরেই ভরসা রাখে। যারা সালাত কায়েম করে এবং আমি যে জীবিকা
তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে- তারাই সত্যিকারের মুমিন। তাদের প্রভুর নিকট তাদের জন্য রয়েছে মর্যাদা, মা এবং সম্মানজনক জীবিকা। (সূরা আনফাল : ২-৪)
- অবশ্যই (ঐ সব) মু’মিনগণ সফল হয়েছে। যারা তাদের সালাতে সমর্পিত প্রাণ বিনয়ী ও নিষ্ঠাবান হয়। যারা বাজে কথা ও কাজ থেকে দূরে থাকে। যারা তাদের যাবতীয় কার্যক্রম পবিত্র ও
পরিশুদ্ধ করে। যারা নিজেদের গুপ্তাঙ্গ হিফাযত করে তবে তাদের স্ত্রীদের এবং অধিকারভুক্ত
দাসীদের ক্ষেেত্র কোন দোষ নেই। যারা এ সীমা লংঘন করবে, তারাই হল সীমালংঘনকারী। যারা নিজেদের আমানত রা করে এবং ওয়াদা পূরণ করে। যারা নিজেদের সালাতের হিফাযত করে। তারাই হল সে সকল লোক, যারা ওয়রিস হবে। উত্তরাধিকারী হবে জান্নাতুল ফিরদাউসের। সেখানে তারা চিরদিন থাকবে। (সূরা মুমিনুন : ১-১১)
মু’মিনীন স্তরে কায়েম থাকার
মাঝে নিহিত রয়েছে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন সফলতার সুসংবাদ। যেমন - আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
- নিশ্চয়ই যারা বলে (ঘোষণা করে), আমাদের প্রভু হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ, অতঃপর
তারা (ঘোষণার উপর) অটল রয়েছে, তাদের প্রতি (সুসংবাদ নিয়ে)
ফিরিশতা অবতীর্ণ হয়, (এবং বলে যে) তোমরা ভয় পেয়ো না, চিন্তা করো না আর সেই জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর যার প্রতিশ্র“তি তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে। পার্থিব জীবনেও আমরা তোমাদের বন্ধু ছিলাম
এবং পরকালেও থাকব, তোমাদের জন্য সেথায় রয়েছে,
যা কিছু তোমাদের বাসনা হবে আর তাও মজুদ রয়েছে, যা কিছু তোমরা চাইবে। আর এগুলো ক্ষমাশীল ও করুণাময়ের পক্ষ থেকে
মেহমানদারী। (সূরা হা-মীম সিজদা : ৩০-৩২)
০ মুসলিমীনের স্তরঃ
আল্লাহ তা'য়ালার মহব্বত অর্জনের
পরবর্তী স্তর হল মুসলিমীনের স্তর। মু’মিনীন স্তরের কোন বান্দা যখন আল্লাহর দরবারে পরিপূর্ণ
আত্মসমর্পণ করেন, তাঁর পছন্দ মোতাবেক জীবন অতিবাহিত করেন তখন
তিনি এই স্তরে প্রবেশ করেন। ঈমানদার ব্যক্তি জীবনের যাবতীয় কাজ যখন
ইখলাসের সাথে কেবলমাত্র আল্লাহর হুকুম মোতাবেক হবে, রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ মোতাবেক
হবে, আল্লাহর বিধান ও রসুলের আদর্শের পরিপন্থী যাবতীয়
আইন-বিধি, নীতি-আদর্শ, পথ-মত, বিদআত, জাহিলিয়াত ও নাফসানিয়াত মুক্ত হবে তখন তারা
এই স্তরের মধ্যে অবস্থান করেন। এ প্রসংগে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
- বলুন! যদি তোমরা আল্লাহর ভালবাসা পেতে চাও, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ সমুহ মাফ করে দিবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময়। (সূরা আলে ইমরান : ৩১)
তারা রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ ঐভাবে অনুসরণ করেন
যেভাবে সাহাবায়ে কেরাম (রা) অনুসরণ করেছেন। এ প্রসংগে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
- মুহাজীর ও আনসারদের অগ্রগামী দল আর যারা যথাযথভাবে তাদের অনুসারী, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট আর
তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। তাদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে এমন জান্নাত
যার পাদদেশ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত। তারা সেখানে অনন্তকাল থাকবে। এটা হল মহান সফলতা। (সূরা তওবাহ : ১০০)
মুসলিমীনের স্তরে কায়েম থাকতে হলে চারটি বৈশিষ্ট্য দরকার। তা হল- ঈমান, আমলে সালেহ, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয়া ও ধৈর্য্যরে উপদেশ দেয়া। এরা যাবতীয় তি থেকে নিরাপত্তা লাভ করে। যেমন- আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
- (১) মহাকালের শপথ! (২)
নিশ্চয় মানবজাতি মহাতির মধ্যে নিমজ্জিত আছে। (৩) কেবলমাত্র তারা বাদে (তির মধ্যে নিমজ্জিত নেই) যারা ঈমান আনে, সৎকাজ করে এবং পরস্পরকে সত্য ও
ধৈর্য্যরে উপদেশ দেয়।-(সূরা আছর)
আল্লাহ তা'য়ালা ঈমানদার বান্দাগণকে
ইসলামের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে দাখিল হয়ে খাঁটি মুসলিম হিসাবে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে
বলেছেন। এ প্রসংগে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
-হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে তেমনিভাবে ভয় কর যেমনিভাবে ভয়
করা উচিত আর মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না (সূরা আলে ইমরান : ১০২)
- হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইসলামের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে দাখিল হয়ে যাও আর শয়তানের
পদাংক অনুসরণ করো না, নিশ্চয়ই শয়তান তোমদের
জন্য প্রকাশ্য দুশমন। (সূরা বাকারাহ : ২০৮)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : বানী-ইসরাইলীগণ
বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল আর আমার উম্মাত বিভক্ত হবে তিয়াত্তর দলে, সকলেই জাহান্নামে যাবে কিন্তু একটি
মাত্র দল জান্নাতে যাবে। সাহাবাগণ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) জিজ্ঞাসা
করলেন- এই দল কারা? রসূলুল্লাহ রসূলুল্লাহ
সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন :
যারা আমার ও আমার সাহাবাগণের আদর্শের উপর কায়েম থাকবে (তিরমিজি-২৫৭৮ : হাসান,
আবু দাউদ, সহীহ তারগীব-৪৮)।
সুতরাং আল্লাহর ভালবাসা পেতে হলে তাগুতের সব ষড়যন্ত্র, মানব রচিত বিধি-বিধান, যাবতীয় ফিত্না, শয়তানের কুমন্ত্রনা ও নাফসের খাহেসাত
থেকে বেঁচে থাকতে হবে। ইসলামের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে দাখিল হতে হবে। সাহাবায়ে কেরাম (রা)- গণের নমুনায় রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
এর খাঁটি অনুসারী হয়ে সত্যিকার মুসলিম হিসেবে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে।
০ মুত্তাকীনের স্তরঃ
আল্লাহ তা'য়ালার মহব্বত অর্জনের
পরবর্তী স্তর হল মুত্তাকীনগণের স্তর। মুসলিমীন বান্দাগণ যখন সর্বদা আল্লাহ তা'য়ালাকে হাজির-নাজির জেনে তাকওয়ার জীবন
ধারা অবলম্বন করেন, গোনাহ থেকে সর্বদা সতর্কতার সাথে পরহেজ
করে চলেন, এমনকি সন্দেহজনক জায়েজ কাজও পরিহার করেন তখন তারা
মুত্তাকীনগণের স্তরে দাখিল হন। আল্লাহর অনুগ্রহে অলীগনের দপ্তরে তাদের
নাম লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। আল্লাহ তা'য়ালা তাদের পরিচয় প্রসংগে বলেন :
- জেনে রাখ! যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের
কোন ভয় নেই আর তারা চিন্তিতও হবে না। তারা হল খাঁটি ঈমানদার ও তাকওয়াবান। তাদের জন্য এ সুসংবাদ রয়েছে দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতের জীবনে। আল্লাহর কালিমার কোন পরিবর্তন হয় না। এটা হচ্ছে তাদের বিরাট সফলতা। (সূরা ইউনুস : ৬২-৬৪)
হযরত আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন : আল্লাহ তা'য়ালার বান্দাগণের মধ্যে এমন কিছু লোক
রয়েছে, যারা নবীও নয় আর শহীদও নয়। কিন্তু বিচার দিবসে তাদের মর্যাদা দেখে নবী ও শহীদগণ তাদের উপর রিশ্ক করবেন। জিজ্ঞেস করা হল, হে আল্লাহর রসূল! তারা
কারা? উত্তরে তিনি বললেন : তারা হচ্ছে সেই সব লোক, যারা শুধু আল্লাহর মহব্বতে একে অপরকে মহব্বত করেছে। তাদের মধ্যে নেই কোন রক্তের সম্পর্ক নেই কোন বংশের সম্পর্ক। তাদের মুখমন্ডল হবে জ্যোতির্ময় এবং তারা নূরের মিম্বরের উপর অবস্থান করবে। কিয়ামতের বিভীষিকাময় অবস্থায় মানুষ যখন ভীত-সন্ত্রস্ত থাকবে তখন তারা ভীত হবে
না আর মানুষ যখন দুঃখে থাকবে তখন তাদের কোন দুঃখ থাকবে না। অতঃপর তিনি পাঠ করলেন- জেনে রাখ! আল্লাহর অলীদের কোন ভয় নাই এবং তারা চিন্তিতও
হবে না। (আবু দাউদ)
০ মুহসিনীনের স্তরঃ
আল্লাহ তা'য়ালার মহব্বত অর্জনের
পরবর্তী স্তর হল মুহসিনীনগণের স্তর। মুত্তাকীন বান্দাগণ যখন আল্লাহ তা'য়ালাকে সর্বদা সংগে নিয়ে ইহসানের জীবন
ধারা অবলম্বন করেন, তখন তারা প্রথম শ্রেনীর অলীআল্লাহ মুহসিনীনগণের
স্তরে দাখিল হন। মুহসিনীন বান্দাগণ সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা'য়ালার জিকিরে নিমগ্ন থাকেন, আল্লাহর জন্যই একে-অপরকে ভালবাসেন আর আল্লাহর জন্যই শত্র“তা পোষণ করেন, গোনাহের কাজ পরিত্যাগ করার সাথে সাথে
তারা মোবাহ কাজ ও কথা অপ্রয়োজনীয় বলে পরিহার করেন এবং সর্বদা ছুন্নাতের উপর আমল
করেন। এমনকি তারা খানা পিনা, বিবাহ-শাদী ও অন্যান্য
জরুরী কাজকর্ম নাফসানী চাহিদায় নয়, বরং আল্লাহর হুকুম ও
রসুলের ছুন্নাত হিসাবে সম্পাদন করেন।
ইহসানের সংজ্ঞা : রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন :
এমনভাবে আল্লাহর ইবাদাত (জীবন অতিবাহিত) কর যেন তুমি তাকে দেখতে পাচ্ছ আর যদি তাকে
নাও দেখ, তিনি তো তোমাকে অবশ্যই
দেখছেন। -(ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)
মুহসিনীন বান্দাগণ আল্লাহ তা'য়ালাকে হাজির-নাজির জেনে সর্বদা এ ধারণা রাখেন যে, আল্লাহ
তার সাথে রয়েছেন। যেমন- আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
- যারা আমার পথে সাধনা করে আমি অবশ্যই তাদের সুপথে পরিচালিত করব আর আল্লাহ
অবশ্যই মুহসিনীনগণের সংগে রয়েছেন। - (আনকাবুত : ৬৯)
মুহসিনীন বান্দাগণ সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে সর্বাবস্থায় তাদের প্রভু আল্লাহ তা'য়ালার উপর সন্তুষ্ট থাকেন। এ প্রসংগে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
- যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পন করে এবং ইহসানের জীবনধারা
অবলম্বন করে, সে অতি নির্ভরযোগ্য হাতল
ধারণ করে আর সকল কাজের ফলাফল আল্লাহর কাছে। (সূরা লোকমান : ২২)
মুহসিনীনগণ সর্বদা আল্লাহর জিকিরে মগ্ন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু)
থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহর বন্ধু কারা?
উত্তরে তিনি বললেন : তারা হচ্ছে ওরাই যাদেরকে তুমি দেখতে পাও যে,
আল্লাহর স্মরনে নিমগ্ন রয়েছে।
মুহসিনীনগণ পরস্পরকে ভালবাসে কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ
সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, মহান
আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন : যারা আমার সন্তুষ্টির আশায় পরস্পরকে
ভালবাসে, আমার রেজামন্দির আশায় পরস্পর বৈঠকে মিলিত হয়,
আমার সন্তুষ্টির কামনায় পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ করে এবং আমার ভালবাসার
জন্যই নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তাদেরকে ভালবাসা আমার জন্য
ওয়াজিব হয়ে যায়। (মুয়াত্তা ইমাম মালেক)
মুসলিমীন, মুত্তাকীন ও মুহসিনীন এই
তিন স্তরকে কখনও কখনও একত্রে সলিহীনের স্তরও বলা হয়। নামাজের মধ্যে সূরা ফাতিহায় সর্বদা আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত বান্দাগণের অনুসৃত
সঠিক পথের প্রার্থনা করা হয়, তার সন্ধান হল সলিহীনের স্তর।
যেমন- আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
- আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রসুলের হুকুম মান্য করবে, সে তাদের সংগী হবে-যাদের প্রতি
আল্লাহ নিয়ামত দান করেছেন তারা হলেন নবীগণ, সিদ্দিকগণ,
শহীদগণ ও সলেহীনগন আর তাদের সান্নিধ্যই হল উত্তম। (সূরা নিছা : ৬৯)
০ মুজাহীদ ও শহীদগণের স্তরঃ
আল্লাহর মহব্বত অর্জনের পরবর্তী স্তর হল মুজাহীদ ও শহীদগণের স্তর। মুহসিনীন বান্দাগণ যখন তাদের জান ও মাল, জ্ঞান ও দতা, সময় ও অভিজ্ঞতা, সম্মান ও মতা ইত্যাদি আল্লাহ প্রদত্ত সমস্ত নিয়ামত আল্লাহ তা'য়ালার মহব্বতে সম্পূর্ণ ওয়াক্ফ করে দেন এবং আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়ার বুকে
বিজয়ী করার জন্য অবিরত সংগ্রাম-সাধনায় নিয়োজিত হন তখন তারা এই স্তরে প্রবেশ করেন। আল্লাহর মহব্বতে এই ওয়াকফ করাকে তিনি তার কাছে বিক্রি বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং
বিনিময় হিসাবে জান্নাত নির্ধারণ করেছেন, যার ওয়াদা তাওরাত, ইঞ্জীল ও কুরআনে
রয়েছে। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
- নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের নিকট থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে
ক্রয় করে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, হত্যা করে ও নিহত হয়। তাওরাত, ইনজীল ও কুরআনে এ সম্পর্কে সত্য ওয়াদা রয়েছে। নিজের ওয়াদা পালনের ক্ষেত্রে আল্লাহর চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কে আছে? অতএব তোমরা তোমাদের সে কেনা-বেচার জন্য আনন্দিত হও, যে কেনা-বেচা তোমরা আল্লাহর সাথে করেছো। আর এটাই তো মহাসাফল্য। (সূরা তওবা : ১১১)
এই স্তরে জান ও মাল কুরবানীর মাত্রা অনুযায়ী পাঁচটি ধাপের পুরস্কার রয়েছে। যথা- আখিরাতে জাহান্নাম থেকে মুক্তি, গুনাহ মাফ, জান্নাতে আদন, পবিত্র বাসস্থান এবং দুনিয়ায় আল্লাহর সাহায্য ও নিকট বিজয়। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
- হে মুমিনগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি ব্যবসায়ের কথা বলে দেব, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি
থেকে রা করবে? (তা হল) ‘তোমরা আল্লাহ ও
তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও
তোমাদের জীবন দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা জানতে! আল্লাহ তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন, তোমাদেরকে
এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার নিচ দিয়ে ঝর্ণাসমূহ প্রবাহিত, তোমাদেরকে প্রদান করবেন ‘জান্নাতে আদন’ এর মাঝে পবিত্রতম বাসস্থান। বস্তুত এটাই হল মহাসাফল্য। আর আল্লাহ তোমাদেরকে এমন একটি অনুগ্রহও দান করবেন, যা তোমরা পছন্দ করবে। তা হল আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও নিকটবর্তী বিজয়। মুমিনদেরকে এ সুসংবাদ প্রদান করুন। (সূরা সফ : ১০-১৩)
অন্যান্য স্তর থেকেও সরাসরি এই স্তরে দাখিল হওয়া যায়। সে ক্ষেেত্র প্রয়োজন হল নিয়াতের বিশুদ্ধতার উপর অবিচল থাকা এবং আল্লাহ প্রদত্ত
সমস্ত নিয়ামত আল্লাহর মহব্বতে ওয়াকফ করার ক্ষেেত্র সম্পূর্ণ নাফসানিয়াত মুক্ত হওয়া। অন্যথায় এ সুমহান কুরবানী আল্লাহর মহব্বত ও জান্নাত অর্জনের পরিবর্তে আল্লাহর
ক্রোধ ও জাহান্নাম লাভের কারণ হতে পারে। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
- নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন, যারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে সীসাঢালা প্রাচীরের মত সংঘবদ্ধ
হয়ে। (সূরা সফ : ৪) তিনি আরও বলেন :
- যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত মনে করো না, বরং তাদের প্রভুর কাছে তারা জীবিত,
সেখানে তাদেরকে রিজিক দেয়া হয়। তারা তাদের প্রভুর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত অনুগ্রহে আনন্দিত। (সূরা আলে ইমরান : ১৬৯-১৭০)
- হে ঈমানদারগণ! তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি স্বীয় জীবনব্যবস্থা ত্যাগ করে (তার
জেনে রাখা উচিত), অতি সত্তর আল্লাহ এমন এক
সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, যাদের তিনি ভালবাসবেন এবং তারাও
তাকে ভালবাসবে, তারা ঈমানদারদের প্রতি থাকবে অত্যন্ত সদয় এবং
কাফেরদের প্রতি থাকবে অত্যন্ত কঠোর, তারা আল্লাহর পথে জিহাদ
করবে আর কোন নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া করবে না, এটা আল্লাহর
অনুগ্রহ যা তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন, আল্লাহ ব্যাপকতার
অধিকারী ও মহাজ্ঞানী। (সূরা মায়েদা : ৫৪)
- যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং আল্লাহর
পথে স্বীয় জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করেছে, আল্লাহর কাছে তাদের
জন্য রয়েছে সুবিশাল মর্যাদা আর তারাই হবে সফলকাম। (সূরা তওবা : ২০)
হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্র্ণিত। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : মুসলিম মিল্লাতের কোন
ব্যক্তি ণকালের জন্যও আল্লাহর পথে জিহাদ করলে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। (আবুদাউদ. তিরমিযী ও মুসনাদে আহমাদ)
হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্র্ণিত। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : আল্লাহর পথে বান্দার দুটি
পা ধুলিধূসরিত হবে আবার তাকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে- এমনটি কখনও হতে পারে
না। (বুখারী)
হযরত যায়িদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্র্ণিত। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন : আল্লাহর পথে
জিহাদকারীকে যে ব্যক্তি সাহায্য-সরঞ্জাম দেয় সেও মুজাহীদ দলের অন্তর্ভূক্ত আর
মুজাহীদের অবর্তমানে যে ব্যক্তি তার পরিবার পরিজনের দেখাশুনা করে সেও মুজাহীদ দলের
অন্তর্ভূক্ত। (বুখারী ও মুসলিম)
হযরত আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্র্ণিত। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন : যে ব্যক্তি এমন
অবস্থায় মারা গেল যে, সে জিহাদ করেনি বা
জিহাদের কোন চিন্তাও তার মনে আসেনি, তার মৃত্যু হল নিফাকের
একটি স্বভাবের উপর। (ইমাম মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)
হযরত সাহল (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্র্ণিত। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যদি কোন ব্যক্তি খাঁটি
দিলে শাহাদাতের জন্য দোয়া করে স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও আল্লাহ তাকে শহীদদের স্তরে
পৌঁছিয়ে দেন। (মুসলিম)
০ সদিকীনের স্তরঃ
আল্লাহ তা'য়ালার মহব্বত অর্জনের
পরবর্তী স্তর হল সদিকীন বান্দাগণের স্তর। মুজাহিদীন স্তরের বান্দাগণ আল্লাহর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু, নবী-রসূল (আ)-গণের প্রকৃত ওয়ারিস বা
প্রতিনিধি, সাহাবাগণের জীবন্ত মডেল বা নমুনা, মানব জাতির জন্য প্রকৃত শাহীদ এবং উম্মাহর জন্য প্রকৃত মুয়াল্লিম বা
শিক্ষক হতে পারেন- যাকে দেখেই দ্বীন সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা ও আমল করা যায় যেভাবে
সাহাবায়ে কিরামগণ রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দেখে দ্বীন
সম্পর্কে শিখতে পেরেছিলেন এবং আল্লাহর বান্দাগণকে আল্লাহর অলি হওয়ার সঠিক পথের
সন্ধান দিতে পারেন, তখন তারা এই স্তরে দাখিল হন। এই স্তরকে সিদ্দিকগণের স্তরও বলা হয়। এর প্রধান হলেন সিদ্দিকে আকবর হযরত আবুবকর
(রা)।
আল্লাহ তা'য়ালা মু’মিনীন বান্দাগনকে তাকওয়ার জীবন ধারা অবলম্বন করে সদিকীনগণের অনুসারী হওয়ার
নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসংগে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
- হে ঈমানদার বান্দাগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করে চল এবং (তাকওয়া অর্জনের জন্য)
সদিকীনগণের সংগী হও। (সূরা তওবা : ১১৯)
- আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রসুলের হুকুম মান্য করবে, সে তাদের সংগী হবে- যাদের প্রতি
আল্লাহ নিয়ামত দান করেছেন, তারা হলেন- নবীগণ, সিদ্দিকগণ, শহীদগণ ও সলেহীনগণ আর তাদের সান্নিধ্যই
হল উত্তম।
(সূরা নিছা : ৬৯)
উল্লেখিত আয়াতসমুহে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সুস্পষ্ট ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। যথা-
(১) রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে আর কোন
নবী-রসূল দুনিয়াতে আসবেন না। যদি আসত তাহলে আল্লাহ সদিকীনের অনুসরণ
করতে না বলে, বরং পরবর্তী নবী-রসূলগণের
(আ) অনুসরণ করতে বলতেন।
(২) সদিকীনগণই নবী-রসূলগণের (আ) প্রকৃত প্রতিনিধি ও সত্যিকার ওয়ারিস। নবী-রসূলগণের (আ) অবর্তমানে যাদের অনুসরণ করা অপরিহার্য।
(৩) তাকওয়া ভিত্তিক জীবন গঠন এবং এর উপর কায়েম থাকতে হলে
উম্মাহকে নবী-রসূলগণের (আ) অবর্তমানে সদিকীনগণের অনুসরণ করতে হবে।
(৪) দুনিয়ার বুকে নবুওয়াতের নমুনায় খিলাফত কায়েমের সংগ্রামে
যারা নেতৃত্ব দিতে চান ও মু’মীনগণকে সংগী হিসাবে পেতে চান
তাদেরকে নবী-রসূল (আ)-গণের সত্যিকার ওয়ারিস তথা সদিকীন স্তরের অন্তর্ভূক্ত হতে হবে।
(৫) আল্লাহ অনুগ্রহপ্রাপ্ত বান্দাগণের মধ্যে নবী-রসূল (আ)-গণের
পরেই সিদ্দিকগণের অবস্থান। আল্লাহর হুকুম ও রসূলের তরিকা মান্য করার
মাধ্যমেই তাদের সংগী হওয়া যাবে, যার জন্য সূরা ফাতিহায় প্রার্থনা করা হয়।
০ খুলাফায়ে রাশিদীনের স্তরঃ
আল্লাহ তা'য়ালার মহব্বত অর্জনের
পরবর্তী স্তর হল খুলাফায়ে রাশিদীনের স্তর। আল্লাহ তা'য়ালা সদিকীন বান্দাগনের
মধ্য থেকে নবুওয়াতের অনুকরণে খিলাফাত পরিচালনার জন্য যাকে ইচ্ছা কবুল করে থাকেন। যদিও আহলুর রায়গণের (রায় বা ভোট প্রদান করার যোগ্যতা সম্পন্ন মহান
ব্যক্তিবর্গ) অধিকাংশ মতামতের ভিত্তিতে খলিফাতুল মুসলিমীন নির্বাচিত হয় এবং
সার্বজনীন বাইয়াত এর মাধ্যমে খিলাফত কার্যকরী হয়, তবুও আল্লাহ তা'য়ালার মাকবুল বান্দাগণই
খলিফাতুল মুসলিমীন হওয়ার প্রকৃত হকদার। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
- তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে আল্লাহ তাদেরকে
প্রতিশ্র“তি দিচ্ছেন যে, তিনি অবশ্যই
তাদেরকে পৃথিবীতে খিলাফাত দান করবেন,
যেমন তিনি খিলাফাত দান করেছেন তাদের আগের লোকদের আর তিনি
তাদের জন্য অবশ্যই তাদের দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করবেন যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ
করেছেন। তাদেরকে তিনি ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন। (এ জন্য যে) তারা আমার ইবাদত করবে, আমার সাথে কোন শরীক করবে না, এরপর যারা অবিশ্বাসী হবে, তারা তো সীমালংঘনকারী। (সূরা নূর : ৫৫)
খিলাফাত হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত মাসজিদ কেন্দ্রিক কল্যাণময় প্রসাশনিক
ব্যবস্থা, যার জন্য আল্লাহ তা'য়ালা যুগে যুগে নবী-রসূল (আ)-গণকে
মনোনীত করেছেন। নবুয়তী ছিলছিলা সমাপ্তির পর খুলাফায়ে
রাশিদীন মুসলিম উম্মাহর জন্য এর বাস্তব মডেল রেখে গেছেন। খলিফাগণ হচ্ছেন, রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতিনিধি, মুসলিম উম্মাহর ইমাম,
আল্লাহর হুকুম ও তাঁর রসূলের ছুন্নাতের সীমারেখার সংরক এবং মানব
জাতির পথ প্রদর্শক।
উম্মাহর জন্য অপরিহার্য ফরজ হল নবুওয়াতের নমুনায় খিলাফত, যার মাঝে নিহিত রয়েছে উম্মাহর
ইহজাগতিক ও পারলৌকিক কল্যাণ। এ ব্যবস্থা কায়েম করতে হলে পাশ্চাত্য
গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, শ্রেণী-সংগ্রাম, সামরিক কৌশল বা অন্য কোন মনগড়া
পন্থায় নয়, বরং খিলাফতের নিজস্ব পন্থায় অর্থাৎ নবী-রসূল (আ)
ও খুলাফায়ে রাশিদীন (রা)-গণের অনুসৃত পন্থায় সাধনা করতে হবে।
০ নাবিয়্যীনের স্তরঃ
আল্লাহ তা'য়ালার মহব্বত অর্জনের
চুড়ান্ত স্তর হল নবী-রসুলগণের (আঃ) স্তর। আল্লাহ তা'য়ালা মানব জাতির হিদায়াতের
জন্য দুনিয়ার বুকে প্রত্যেক কওমের মাঝে অসংখ্য নবী-রসূল প্রেরণ করেছেন আল্লাহ বলেন
:
-নিশ্চয়ই আমি প্রত্যেক উম্মাতের নিকট এ মর্মে রসূল প্রেরণ করেছি
যে, তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুতকে অস্বীকার কর। - (সূরা নহল: ৩৬)
নবী-রসূল (আ)-গণকে স্বয়ং আল্লাহ তা'য়ালা মনোনীত করেন, পাক-পংকিলতা থেকে
হিফাজত করেন এবং রিসালাতের গুরুদায়িত্ব বহনের উপযোগী করে গড়ে তোলেন। কোন সাধনার মাধ্যমে এই স্তরে উপনীত হওয়া যায় না।
মানব জাতির দায়িত্ব ও কর্তব্যঃ
হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত দুনিয়ায় যত নবী-রসূল (আ) আগমন করেছেন এবং তাদের উপর আল্লাহ যে
অহী বা কিতাব নাজিল করেছেন তার সত্যতার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা সর্বকালের সকল
মানুষের জন্য অপরিহার্য্য। তবে পালন করার ক্ষেেত্র সমকালীন নবীর
নির্দেশিত শরীয়াত মেনে চলতে হবে। যেহেতু হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বিশ্বের সমস্ত মানব জাতির জন্য সর্বশেষ রসূল, তাই বিশ্বে প্রচলিত সকল নবীর অনুসারী
সবার অপরিহার্য্য কর্তব্য হল তার আনীত শরীয়াতের অনুসরণ করা। এ মহাসত্যের উপলব্ধির মাঝেই নিহিত রয়েছে বিশ্ব মানবতার সার্বিক কল্যাণ ও
সমৃদ্ধি। আল্লাহ তা'য়ালা বিশ্বের সমগ্র মানব
জাতিকে এ মহাসত্য উপলব্ধির মাধ্যমে ইহ-জাগতিক ও পারলৌকিক কল্যাণ লাভ করার তৌফিক
দান করুন। আ-মী-ন।
No comments:
Post a Comment