Monday, March 3, 2014

ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব



ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব
ডাঃ গাজী মোঃ নজরুল ইসলাম

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা'য়ালার জন্য যিনি রব্বুল আলামীনদুরুদ ও সালাম রসূলুল্লাহ্ সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি যিনি রহমাতুল্লিল আলামীন, তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কিরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) এবং সালেহীন (র)-গণের প্রতিআমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, ল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাইআমরা আরও স্বাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর বান্দাহ ও রসূলনিশ্চয়ই শুভ পরিণতি কেবলমাত্র মুত্তাকীনদের জন্য নির্ধারিত

আল্লাহ্ তা'য়ালা মানব জাতির হেদায়েতের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী এই পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। তাঁরা মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। এ পৃথিবীতে ১ লাখ ২৪ হাজার পয়গম্বর বা নবী-রাসুল এসেছেন। তারা সবাই স্বজাতির মাতৃভাষায় কথা বলতেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের প্রতি নাজিলকৃত আসমানি কিতাব ও ছহিফাগুলোও স্বজাতির মাতৃভাষায় প্রচার করতেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক কুরআনে উল্লেখ করেছেন : আমি সব পয়গম্বরকে তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই পাঠিয়েছি যাতে তাদের পরিষ্কার করে বুঝাতে পারে। -(সুরা ইব্রাহিম : আয়াত- ৪)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হয়েছে, “আল্লাহ পাক পয়গম্বরগণের প্রতি যত কিতাব নাজিল করেছেন সেগুলোর আসল ভাষা ছিল আরবি জিব্রাঈল (আলাহিসসালাম) তার নিজ নিজ পয়গম্বরের জাতীয় ভাষায় অনুবাদ করে নবী রাসুলগণের কাছে পৌঁছাতেন”। যেমন তাওরাত, জাবুর, ইনজিল প্রভৃতি কিতাব কোনোটা ইবরানি, কোনোটা হিব্রু, কোনোটা সুরিয়ানি বা ইউনানি ভাষায় রূপান্তরিত করে নবী-রাসুলগণের কাছে পৌঁছানো হয়েছে। নবী-রাসুল (আ)-গণও নিজ নিজ কওমের কাছে তাদের স্বজাতীয় ভাষায় আল্লাহর বানী যথাযথভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। অতএব হাদিস শরিফ থেকে প্রমাণিত হল যে, প্রত্যেক নবী-রাসুলই আপন জাতির মাতৃভাষায় আসমানি গ্রন্থাবলির নির্দেশিকা প্রচার করতেন। মূলত পয়গম্বরদের ইসলাম প্রচারের মাধ্যম ছিল মাতৃভাষা।

বিশ্বনবীর মাতৃভাষায় ইসলাম প্রচার : আমাদের সর্বশেষ প্রিয়নবী বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাতৃভাষা ছিল আরবি। আর সর্বশেষ আসমানিগ্রন্থ আল-কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে তাঁর মাতৃভাষাতেই। অতঃপর তিনি মাতৃভাষাতেই কোরআনের বাণী প্রচার করে জগ
কে আলোকিত করেছেন। আল্লাহ তা'য়ালা নবীজীর মাতৃভাষাতে কোরআন নাজিল করে তা সহজ করে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন : এটা রুহুল আমিন-জিব্রাইলের মাধ্যমে আপনার অন্তকরণে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করা হয়েছে। যাতে ভয় প্রদর্শনকারী হতে পারেন। -(সুরা শুয়ারা : আয়াত ১১৩-১১৫)

যারা কুরআন ও ছুন্নাহ নিয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী, তাদেরকে অবশ্যই আরবী ভাষায় পারদর্শী হতে হবে। কুরআন ও ছুন্নাহকে অবশ্যই ত
কালীন প্রচলিত আরবী ভাষায় এর অন্তর্নিহিত অর্থ ও শিক্ষা উপলব্ধি করতে হবে। তবে শুধু আমল, প্রচার ও শিক্ষাদানের জন্য মাতৃভাষাই সর্বোত্তম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন : অতঃপর আমরা এ কোরআনকে আপনার মাতৃভাষায় সহজ করে দিয়েছি, যাতে এর মাধ্যমে আপনি মুত্তাকিদেরকে এর (জান্নাতের) সুসংবাদ দিতে পারেন আর এর সাহায্যে কলহে লিপ্ত জাতিকে (জাহান্নামের) ভয় দেখাতে পারেন । - (সুরা মারইয়াম : আয়াত-৯৭)

আরবী ভাষায় ইসলাম প্রচার : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম মাতৃভাষার মাধ্যমে ইসলামকে তুলে ধরে কুরআনের ভাষা আরবিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হন। আমাদের এ ভারতীয় উপমহাদেশেও ইসলাম প্রচারক উলামায়ে কেরামগণ যারা ইসলামের বাণী প্রচার করতে এসেছিলেন, তারাও আরবি ভাষাকেই এ দেশের মাতৃভাষায় রূপান্তর করে আমাদের পূর্বপুরুষদের ইসলামে দীক্ষিত করে তুলেছিলেন। এ দেশে ইংরেজদের আগমনে আগে মুসলমানরা প্রায় ৭০০ বছর পর্যন্ত শাসন করে ইসলামের সুমহান শিক্ষা-সভ্যতা প্রবর্তন ও লালন করেছিলেন।

বাংলা ভাষায় ইসলাম প্রচার : এ উপমহাদেশে ফার্সি, উর্দু, বাংলা ভাষায় কুরআন, হাদিসের প্রচুর গবেষণা ও বই পুস্তক রচনা করা হয়। আরবি ভাষার কুরআন ও হাদিসের বাণী এ দেশের মাতৃভাষার মাধ্যমে ব্যাপক চর্চার ফলে এখানকার মানুষের মধ্যে ইসলামের ব্যাপক প্রচার-প্রসার ঘটে। বর্তমানে বাংলা ভাষায় কুরআন তাফসির, হাদিস ও অন্যান্য বিষয়ের যে বিশাল ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে তাতে মাতৃভাষায় যে গুরুত্ব বহন করে তা অবাক করার মতো। বাংলাদেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশন, আধুনিক প্রকাশনীসহ অসংখ্য প্রকাশনা সংস্থা মাতৃভাষায় যে সব কিতাবাদি বই পুস্তক রচনা ও অনুবাদ করেছে তা সত্যিই অতুলনীয়। বাংলা ভাষায় ইসলাম চর্চা এ দেশে সত্যিকার অর্থে এক যুগান্তকারী অধ্যায় সূচিত করেছে। 

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন : বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষায় শহীদদের সম্মানে ২১শে ফেব্রুয়ারী বিশ্বময় পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। যারা সেদিন শাহাদাত বরণ করেছিলেন তারা সবাই মুসলিম। মুসলিম শহীদি আত্মার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ইসলামী তরিকা রয়েছে। সুতরাং ইসলামী তরিকায় তাদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করা শহীদি আত্মার মৌলিক ধর্মীয় অধিকার। অথচ ইসলামী তরিকা বাদ দিয়ে শহীদি আত্মার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নামে হিন্দু-খৃষ্টান ধর্মীয় তরিকায় যা কিছু করা হচ্ছে, তা শহীদি আত্মার মৌলিক ধর্মীয় অধিকারের পরিপন্থি। কোন মুসলিম ইসলামী তরিকার পরিপন্থি কোন কাজে অংশ গ্রহণ, সমর্থন বা সহযোগীতা করতে পারে না। বিষয়টি ভেবে দেখা প্রয়োজন।

মাতৃভাষায় ইসলাম চর্চার নামে আমাদের সমাজে বাংলা ভাষায় জুমআর খুতবা প্রদানের পক্ষে জোর প্রচারণা চালানো হচ্ছে। কিন্তু খুলফায়ে রাশিদীনের যামানায় ইসলাম যখন আরব ভুখন্ড অতিক্রম করে বিশ্বজুড়ে দ্বীনের আলো প্রজ্জলিত করেছিল তখন থেকে অদ্যাবধি কখনও কোথাও স্থানীয় আঞ্চলিক বা মাতৃভাষায় জুমআর খুতবা পাঠ করা হয় নাই। বিভিন্ন দেশের উলামাগণের কেউই কখনো মাতৃভাষায় জুমআর খুতবা প্রদান করেন নাই। মনে রাখবেন! খুতবা জুমআর নামাজের অংশ। আর নামাজের কোন অংশেই আরবী ছাড়া অন্য কোন ভাষা ব্যবহার করা যায় না। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে অদ্যাবধি উম্মাতের উলামাগণের ইজমা হল- জুমআর খুতবা আরবী ভাষায় হতে হবে।

বাংলা ভাষা তথা আমাদের মাতৃভাষা আজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন এ ভাষাতে ইসলাম চর্চা আরো ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হবে। ইসলাম যেমন আরবীয় মরু অঞ্চল পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল ঠিক তেমনি বাংলা ভাষা তথা মাতৃভাষার মাধ্যমে আমরা ইসলামের চর্চাকে আরো বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হবো - ইনশা আল্লাহ। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে মাতৃভাষার মাধ্যমে কুরআন ও ছুন্নাহ বুঝার এবং মহান দ্বীনের ব্যাপক খেদমত করার তৌফিক দান করুন, আ-মী-ন।

No comments:

Post a Comment