Monday, March 3, 2014

সর্বসাধারণের সাথে উত্তম ব্যবহার

সর্বসাধারণের সাথে উত্তম ব্যবহার



একটি কল্যাণময় সমাজে পারস্পরিক উত্তম আচরণ সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসে বহু নির্দেশনা রয়েছে। নমুনা স্বরূপ এর কিছু দিক তুলে ধরা হল। যেমন-

মানুষের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্র্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : দয়ালুদের প্রতি আল্লাহ দয়া করেন। যারা যমীনে আছে তাদের প্রতি তোমরা দয়া কর, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। দয়া রহমান থেকে উদ্গত। যে ব্যক্তি দয়ার বন্ধন অুন্ন রাখে আল্লাহও তার সাথে নিজ বন্ধন অুন্ন রাখেন। আর যে ব্যক্তি দয়ার বন্ধন ছিন্ন করে আল্লাহও তার সাথে দয়ার বন্ধন ছিন্ন করেন। (আবু দাউদ, তিরমিযী-১৮৭৪ : হাসান ও সহীহ্)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্র্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তোমরা দয়াময় রহমানের ইবাদাত কর, (মানুষকে) আহার করাও এবং ছালামের ব্যাপক প্রসার কর, তবেই শান্তিতে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। (তিরমিযী-১৮০৩ : হাসান ও সহীহ্)

হযরত জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ (রা) থেকে বর্র্ণিত। রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে ব্যাক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না আল্লাহ তাকে দয়া করেন না। (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী-১৮৭৯ : হাসান ও সহীহ্)

মুসলিম সর্বসাধারণের কল্যাণ কামনা : হযরত জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ (রা) থেকে বর্র্ণিত। তিনি বলেন, আমি নব্ ীসল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে নামাজ কায়েম, যাকাত প্রদান ও প্রত্যেক মুসলিমের কল্যাণ কামনার শপথ করেছি। (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী-১৮৭৬ : হাসান ও সহীহ্)

হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্র্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : দ্বীন হল কল্যাণ কামনার নাম। একথা তিনি তিনবার বলেন। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! কার কল্যাণ কামনা করা? তিনি বললেন : আল্লাহ, তাঁর কিতাবের, মুসলিম নেতৃবর্গের এবং মুসলিম সর্বসাধারণের। (তিরমিযী-১৮৭৫ : হাসান ও সহীহ)

কল্যাণের পথে আহ্বান : আল্লাহ বলেন- তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা প্রয়োজন যারা (মানুষকে) কল্যাণের পথে আহ্বান করবে, কাজের আদেশ দেবে, অস কাজে নিষেধ করবে। এরাই সফলকাম। (আলে ইমরান : ১০৪)

সহমর্মিতা : হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের পার্থিব কষ্টসমূহের একটি কষ্ট দুর করে দেয়, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার একটি বড় কষ্ট দুর করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোন অভাবীর অভাবের কষ্ট লাঘব করে দেয়, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার অভাবের কষ্ট লাঘব করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ গোপন রাখে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। বান্দা যতণ তার মুসলিম ভাইয়ের সাহায্য করতে থাকে আল্লাহও ততণ তার সাহায্য করতে থাকেন । (মুসলিম, তিরমিযী-১৮৮০ : হাসান )

সত্যবাদীতা : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তোমরা অবশ্যই সত্য অবলম্বন করবে। কেননা সততা মানুষকে কল্যাণের পথে নিয়ে যায়। কোন মানুষ সদা সত্য কথা বলতে থাকলেএবং সত্যের উপর মনোযোগী থাকলে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর দরবারে পরম সত্যবাদী হিসাবে তালিকাভূক্ত হয়। আর তোমরা অবশ্যই মিথ্যা পরিহার করবে। কেননা মিথ্যা মানুষকে পাপের দিকে পথ দেখায়, আর পাপ দোযখের দিকে নিয়ে যায়। কোন বান্দা সর্বদা মিথ্যা বলতে থাকলে এবং মিথ্যার প্রতি ঝুকে থাকলে শেষ পর্যন্ত সে আল্লাহর দরবারে চরম মিথ্যাবাদী হিসাবে তালিকাভূক্ত হয়। (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী-১৯২১: হাসান ও সহীহ)

বিনয় ও নম্রতা : হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যাকাত বা দানে কখনো সম্পদের ঘাটতি হয় না। মা ও উদারতার দ্বারা আল্লাহ মান-সম্মান বৃদ্ধি করে দেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করে আল্লাহ তাকে সমুন্নত করেন। (মুসলিম, তিরমিযী-১৯৭৮: হাসান ও সহীহ্)

উত্তম ব্যবহার : হযরত আবু যার (রা) থেকে বর্র্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন : তুমি যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় কর। খারাপ কাজ হয়ে গেলে পরপরই ভাল কাজ কর, তাতে খারাপ দূরীভূত হয়ে যাবে। আর মানুষের সাথে উত্তম ব্যবহার কর। (তিরমিযী- ১৯৩৭)

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্র্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না, বড়দের সম্মান করে না, কাজের নির্দেশ দেয় না, অস কাজে বাধা দেয় না সে আমাদের (দলভূক্ত) নয়। (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী-১৮৭১)

উত্তম চরিত্র : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তিই সর্বোত্তম। (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী-১৯২৫)

ভাল কাজের সুপারিশ : আল্লাহ বলেন : যে ব্যক্তি ভাল কাজের সুপারিশ করবে সে তার থেকে (সওয়াবের) অংশ পাবে আর যে ব্যক্তি খারাপ কাজের সুপারিশ করবে সেও তা থেকে (গুনাহের) অংশ পাবে। (সূরা আন-নিসা : ৮৫)

মুমিনের বৈশিষ্ট্য : হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : তোমাদের মধ্যে কেউই মুমিন হতে পারে না, যতন না সে তার ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করে যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে। (ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু মূসা আশআরী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : এক মুমিন অন্য মুমিনের জন্য প্রাচীর স্বরূপ যার এক অংশ অন্য অংশকে শক্তি যোগায়। তিনি তার এক হাতের আঙুল অন্য হাতের আঙুলের ফাঁকে ঢুকিয়ে দেখান। (বুখারী ও মুসলিম)

হযরত নুমান ইবনে বশীর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : পারস্পরিক ভালবাবাসা, দয়া-অনুগ্রহ ও মায়া-মমতার দৃষ্টিকোন থেকে মুমিনগণ একটি দেহের সমতুল্য যার কোন অংশ অসুস্থ হয়ে পড়লে অন্যান্য অংগ-প্রত্যংগ তা অনুভব করে, সেটা জাগ্রত অবস্থায়ই হোক কিংবা জ্বরের অবস্থায় (অর্থা সর্বাবস্থায়)। (বুখারী ও মুসলিম)

মুসলিমের বৈশিষ্ট্য : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : মুসলিম সেই ব্যক্তি, যার মুখের ও হাতের অনিষ্ট থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে। আর মুহাজির সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর নিষিদ্ধ জিনিষ পরিত্যাগ করে (বুখারী ও মুসলিম)

সর্বাবস্থায় সাহায্য ও সহযোগীতা : : হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : তোমার ভাইকে সাহায্য কর, চাই জালিম হোক অথবা মাজলুম। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রসূল! সে যদি মজলুম হয় আমি তাকে সাহায্য করব, কিন্তু যদি সে জালিম হয় তবে আমি তাকে কিভাবে সাহায্য করব? তিনি বলেন : তাকে জুলুম করা থেকে বিরত রাখ, বাধা দাও। এটাই তাকে সাহায্য করা। (বুখারী)

পারস্পরিক দায়িত্ব : হযরত বারাআ ইবনে আযিব থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সাতটি বিষয় করতে এবং সাতটি বিষয় না করতে নির্দেশ দিয়েছেন : তিনি আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন : রোগীর খোঁজ-খবর নিতে, জানাযায় অংশগ্রহণ করতে, হাঁচির জবাব দিতে, শপথ বা প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করতে, মাজলুমের সাহায্য করতে এবং সালামের ব্যাপক প্রচলন করতে। তিনি আমাদেরকে নিষেধ করেছেন : স্বর্ণের আংটি পরিধান ও তৈরী করতে, রূপার পাত্রে পান করতে, লাল রং এর রেশমের গদিতে বসতে, কাচ্ছি (কাপড়), রেশমীবস্ত্র ও দীবাজ পরিধান করতে। (বুখারী ও মুসলিম)

ভাল কাজে পারস্পরিক সহযোগিতা : আল্লাহ তায়ালা বলেন : সওয়াবের কাজ ও তাকওয়া অবলম্বনে তোমরা পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। পাপ ও সীমালংঘনের কাজে কেউ কাউকে সহযোগিতা করবে না। আল্লাহকে ভয় করবে। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে অত্যন্ত কঠোর। (সূরা মা-ইদা : ২)

পরস্পরের সম্মানের হিফাযত : হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। নব্ ী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : যে বান্দা অন্য বান্দার দোষ-ত্রটি এ পার্থিব জগতে গোপন রাখবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রটি গোপন রাখবেন। (ইমাম মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)

পরস্পরের জীবনের হিফাযত : আল্লাহ বলেন- হত্যার অপরাধ অথবা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করার অপরাধ ছাড়া যদি কেউ কোন ব্যক্তিকে হত্যা করে, তাহলে সে যেন (পৃথিবীর) সমস্ত মানুষকে হত্যা করল। আর যদি কেউ কোন ব্যক্তিকে জীবন দান (অন্যায়ভাবে নিহত হওয়া থেকে রা) করল, সে যেন (পৃথিবীর) সমস্ত মানুষকে জীবন দান করল। (সূরা আল মা-ইদা : ৩২)

পারস্পরিক ভাতৃত্ববোধ : হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : মুসলিম মুসলিমের ভাই। সে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, তাকে মিথ্যা বলবে না, এবং তাকে হেয় প্রতিপন্ন করবে না। প্রত্যেক মুসলিমের মান-ইজ্জত, ধন-সম্পদ ও রক্ত অন্য সব মুসলিমের উপর হারাম। (তিনি বস্থলের দিকে ইশারা করে বলেন) : তাকওয়া এখানে। কোন ব্যক্তির অধম হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে ঘৃণা করে, হেয় প্রতিপন্ন করে। (তিরমিযী : হাসান)

সমঝোতা স্থাপন : আল্লাহ বলেন : মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। অতএব (কোন প্রকার ভুল বোঝা-বুঝি বা বিরোধ হলে) তোমাদের ভাইদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সংশোধন করে সমঝোতা স্থাপন করে দাও। (সূরা হুজরাত : ১০)

সুসম্পর্ক স্থাপন : হযরত উম্মু কুলসুম বিনতে উকবা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি : যে ব্যক্তি লোকদের মাঝে সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে এবং এ ব্যাপারে সে উত্তম (মিথ্যা) কথা বলে বা পৌঁছায়, সে মিথ্যাবাদী নয়। (বুখারী ও মুসলিম)

অমুসলিমদের সাথে সদাচার : হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মুয়ায (রা)-কে ইয়েমেনে পাঠানোর সময় বলেন : মাজলুমের বদ-দোয়াকে ভয় কর কেননা তার বদ-দোয়া ও আল্লাহর মাঝখানে কোন বাধা নেই। (তিরমিযী-১৯৬৩ : হাসান ও সহীহ্)

নির্লজ্জতা ও অসভ্যতা পরিহার : হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : লজ্জা ও সম্ভ্রমবোধ ঈমানের অংগ আর ঈমানের স্থান জান্নাতে। নির্লজ্জতা ও অসভ্যতা জুলুমের অংগ আর জুলুমের স্থান দোযখে।(আহমাদ, তিরমিযী- ১৯৫৮ : হাসান ও সহীহ্)

দ্বিমুখীপনা ও মুনাফেকী পরিহার : হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : দ্বিমুখী চরিত্রের লোকেরা কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট বলে গণ্য হবে। (বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী-১৯৭৪ : হাসান ও সহীহ্)

চোগলখুরী পরিহার : হযরত হাম্মাম ইবনুল হারিস (র) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন এক ব্যক্তি হযরত হুযাইফা ইবনুল ইয়ানকে (রা) অতিক্রম করে যাচ্ছিল। তাকে বলা হল, এই ব্যক্তি জনসাধারণের কথা সরকারের কানে দেয়। হুযাইফা (রা) বলেন, আমি রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি : চোগলখোর বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।(বুখারী ও মুসলিম)
অহংকার পরিহার : হযরত আব্দুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যার অন্তরে সরিষার দানার পরিমানও অহংকার আছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আর যার অন্তরে সরিষার দানার পরিমানও ঈমান আছে সে দোযখে প্রবেশ করবে না। (মুসলিম)

হিংসা পরিহার : হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তোমরা পরস্পর সম্পর্কচ্ছেদ করো না, একে অপরকে এড়িয়ে চলো না, পরস্পর হিংসা করো না, বরং আল্লাহর বান্দাগণ! পরস্পর ভাই ভাই হয়ে থেকো। কোন মুসলিমের পে তার ভাইকে তিনদিনের অধিক ত্যাগ করে থাকা হালাল নয়। (বুখারী ও মুসলিম)

অশ্লীলতার বিস্তার পরিহার : আল্লাহ তায়ালা বলেন : যেসব লোক চায়, ঈমানদারদের মধ্যে নির্লজ্জতা-বেহায়াপনা বিস্তার লাভ করুক, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে রয়েছে কঠিন শাস্তি । (সূরা আন-নূর : ১৯) 

অবৈধ উপার্জন ও ভোগের পরিণাম : হযরত ইবনে উজরা (রা) থেকে বর্র্ণিত। তিনি বলেন, আমাকে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : হে কাব ইবনে উজরা! যে মাংস হারাম খাদ্য দ্বারা প্রতিপালিত হবে, তার জন্য জাহান্নামই উপযুক্ত। (সহীহ তিরমিযী : হাদীস নং- ৫০১)

উস্কানি পরিহার : হযরত জাবির (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: নামাজীরা কখনো শয়তানের পুজা করবে এ ব্যাপারে সে নিরাশ হয়ে গেছে। কিন্তু সে তাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে উস্কানি দিতে নিরাশ হয়নি। (মুসলিম, তিরমিযী-১৮৮৭ : হাসান ও সহীহ্)

গালিগালাজ পরিহার : হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। নব্ ী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : দুই ব্যক্তির পরস্পরকে গালি দেয়ার পরিণাম প্রথম গালি প্রদানকারীর উপর পতিত হয়, যাবত না মাজলুম (দ্বিতীয় ব্যক্তি) সীমা লংঘন করে। (মুসলিম, আবুদাউদ, তিরমিযী- ১৯৩১: হা. স.)
কুধারণা পোষণ পরিহার : আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তোমরা কু ধারণা পোষণ করা থেকে দুরে থাক। কেননা কুধারণা হল সবচেয়ে বড় মিথ্যা কথা। (বুখারী, মুসলিম্)

শত্রতা পরিহার : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : মুসলিমকে গালি দেয়া ফাসেকী আর হত্যা বা তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করা কুফরী। (বুখারী, মুসলিম)

অভিশাপ পরিহার : হযরত সামুরা ইবনে জুনদুব (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তোমরা একে অপরকে আল্লাহর অভিসম্পাত, তাঁর গজব ও জাহান্নামের বদদোয়া করো না। (আহমাদ, হাকেম, তিরমিযী-১৯২৬ : হাসান ও সহীহ্)

সম্পর্ক পরিত্যাগ : হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : সোমবার ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। যেসব পাপী আল্লাহর সাথে শরীক করেনি তাদেরকে মা করা হয়। কিন্তু পরস্পর সম্পর্ক ত্যাগকারী ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয়- এদেরকে ফিরিয়ে দাও যতণ না এরা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা স্থাপন করে। (মুসলিম)

সাতটি সর্বনাশী কাজ : হযরত আবু হুরাইরাহ (রা) থেকে বর্র্ণিত। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : সাতটি সর্বনাশী কাজ থেকে দুরে থাক। সাহাবাগণ (রা) জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রসূল! সেগুলো কি কি? তিনি বললেন : আল্লাহর সাথে শিরক্ করা,যাদু করা, ন্যায় সংগত অধিকার ছাড়া হত্যা করা, সুদ খাওয়া, ইয়াতীমের সম্পদ ভণ করা, জিহাদের ময়দান থেকে পলায়ন করা ও সতী মুমিনা নারীর চরিত্রে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া। (বুখারী-২৭৬৬, মুসলিম)

পাঁচটি অপরাধের দুনিয়াতেই শাস্তি : হযরত ইবনে উমার (রা) থেকে বর্র্ণিত। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : হে মুহাজির দল! পাঁচটি কর্ম এমন রয়েছে যাতে তোমরা লিপ্ত হয়ে পড়লে শাস্তি তোমাদেরকে গ্রাস করবে। আমি আল্লাহর নিকট পানাহ চাই তোমরা যেন তা প্রত্য না কর। (১) যখনই কোন জাতির মধ্যে অশ্লীলতা প্রকাশ্যভাবে ব্যাপক হবে তখন সে জাতির মাঝে প্লেগ ও এমন রোগ ব্যাপক হবে, যা তাদের পূর্বপুরুষদের মাঝে ছিল না। (২) যে জাতি মাপে কম দিবে সে জাতি দুর্ভি, খাদ্য সংকট এবং শাসকগোষ্ঠির অত্যাচারের শিকার হবে। (৩) যে জাতি যাকাত দেয়া বন্ধ করবে সে জাতির জন্য বৃষ্টি বন্ধ করে দেয়া হবে। যদি অন্যান্য প্রাণীকুল না থাকত তাহলে তাদের জন্য আদৌ বৃষ্টি হত না। (৪) যে জাতি আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতিশ্রতি ভংগ করবে সে জাতির উপরে তাদের বিজাতীয় শত্রদলকে মতাসীন করে দেয়া হবে, যারা তাদের বহু ধন-সম্পদ নিজেদের কুগিত করবে। (৫) যে জাতির শাসকগোষ্ঠী আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী দেশ শাসন না করবে ততণ পর্যন্ত তিনি তাদের মাঝে সন্ত্রাস/গৃহযুদ্ধ স্থায়ী রাখবেন। (বায়হাকী ও ইবনে মাজাহ)

পরকালে যারা আল্লাহর রোষাণলে থাকবে : হযরত আবু যার (রা) থেকে বর্র্ণিত। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : কিয়ামাতের দিন তিন ব্যক্তির সাথে আল্লাহ কথা বলবেন না, তাদের প্রতি তাকিয়েও দেখবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। তিনি এ কথাটি পুনঃ পুনঃ তিনবার বললেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! ব্যর্থ ও তিগ্রস্থ হবে, তারা কারা? তিনি বললেন : তারা হল- যে ব্যক্তি টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে পরে, যে ব্যক্তি দান করার পর দিয়েছি দিয়েছিবলে প্রচার করে বেড়ায় এবং যে ব্যক্তি মিথ্যা কসম করে তার পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করে। (মুসলিম)

ঋণ পরিশোধে গড়িমসির পরিণাম : হযরত আবু হুরাইরাহ (রা) থেকে বর্র্ণিত। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : যে ব্যক্তি লোকের মাল নিয়ে তা আদায় করার সংকল্প রাখে সে ব্যক্তির তরফ থেকে আল্লাহ তা আদায়ের ব্যবস্থা করে দেন। আর যে ব্যক্তি আত্মসা করার উদ্দেশ্যে মাল গ্রহণ করে আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দেন। (বুখারী-২৩৮৭, ইবনে মাজাহ-২৪১১)

মিথ্যা কসমের পরিণাম : হযরত আবু উমামাহ (রা) থেকে বর্র্ণিত। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: যে ব্যক্তি মিথ্যা কসম দ্বারা কোন মুসলিমের অধিকার হরণ করে আল্লাহ তার জন্য দোযখ ওয়াজিব ও জান্নাত হারাম করেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রসূল! যদিও সামান্য কিছু হয়, তাহলেও? তিনি বললেন: যদিও পিল্লুগাছের একটি সামান্য ডালও হয়। (মুসলিম-১৩৭)

বিচারের দিন আল্লাহ যাদের বিরূদ্ধে দাড়াবেন : হযরত আবু হুরাইরাহ (রা) থেকে বর্র্ণিত। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : আল্লাহ তায়ালা বলেন- কিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির বিরূদ্ধে দাড়াবো আর আমি যার বিরূদ্ধে দাড়াবো তাকে অবশ্যই পরাজিত করব। প্রথম হল সে ব্যক্তি, যে আমার নামে কিছু দেয়ার প্রতিশ্রতি করল অতঃপর তা ভংগ করল। দ্বিতীয় হল সে ব্যক্তি, যে কোন স্বাধীন লোককে বিক্রয় করে তার মূল্য ভণ করল। তৃতীয় হল সে ব্যক্তি, যে কোন মজুর খাটিয়ে তার নিকট থেকে পুরোপুরি কাজ নিল কিন্তু তার মজুরী পুরোপুরি আদায় করল না। (বুখারী-২২২৭ ও ২২৭০)

কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব: মুমিনগণ যেন মুমিনকে বাদ দিয়ে কোন কাফিরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করে। যে মুমিনকে ছাড়া কাফিরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে তার সাথে আল্লাহর কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে তোমরা যদি তাদের থেকে কোন তির আশংকা কর, তার কথা স্বতন্ত্র। আল্লাহ নিজের থেকে তোমাদেরকে সতর্ক করছেন। আর আল্লাহর নিকটই ফিরে যাওয়া।” (আলে ইমরান: ২৮)

ইহুদি-খৃষ্টানদের সাথে বন্ধুত্ব : আল্লাহ বলেন- হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদি- খৃষ্টানদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ কর না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের যে ব্যক্তি তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে সে তাদেরই বলে গণ্য হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিমদেরকে হিদায়াত প্রদান করেন না। (মায়েদা : ৫১)

বন্ধু নির্বাচন : হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : কোন ব্যক্তি তার বন্ধুর দ্বীনের অনুসারী হয়ে থাকে। কাজেই খেয়াল রাখা উচিত সে কেমন বন্ধু নির্বাচন করছে। (আবু দাউদ ও তিরমিযী)

মাদকতা : হযরত ইবনে উমার (রা) থেকে বর্র্ণিত। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : মদ পানকারী, পরিবেশনকারী, ক্রেতা-বিক্রেতা, প্রস্তুতকারক, যার জন্য প্রস্তুত করা হয়, তার বাহক, যার জন্য বহন করা হয়- সবাইকে আল্লাহ অভিশাপ করেছেন। (আবু দাউদ-৩৬৭৪, ইবনে মাজাহ-৩৩৮০)

কথা বলায় সাবধানতা : হযরত বিলাল বিন হারিস (রা) থেকে বর্র্ণিত। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টির এমনও কথা বলে যার কল্যাণের কথা সে ধারণাই করতে পারে না অথচ তার দরুন কিয়ামত অবধি তাঁর সন্তুষ্টি লিপিবদ্ধ করে দেন। আবার মানুষ আল্লাহর অসন্তুষ্টির এমনও কথা বলে যার অকল্যাণের কথা সে ধারণাই করতে পারে না অথচ তার দরুন কিয়ামত অবধি তাঁর অসন্তুষ্টি লিপিবদ্ধ করে দেন। (তিরমিযী, মুয়াত্তা)

কথায়-কাজে মিল থাকা : আল্লাহ বলেন- হে মুমিনগণ! তোমরা তা কেন বল যা তোমরা কর না? এটা আল্লাহর নিকট অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ। (সফ: ২-৩)

চুটকি বলা : হযরত মুয়াবিয়া বিন হাইদাহ (রা) থেকে বর্র্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি : দুর্ভোগ তার জন্য, যে লোকদেরকে হাসানোর উদ্দেশ্যে মিথ্যা (গল্প বানিয়ে) বলে। দুর্ভোগ তার জন্য, দুর্ভোগ তার জন্য। (আবু দাউদ-৪৯৯০, তিরমিযী)

সফরসংগীদের সাথে সদাচার : হযরত সাহ্ল ইবনে সাদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : সফরকালে দলনেতাই তাদের খাদেম। যে ব্যক্তি খিদমত করে অগ্রগামী হয়ে গেছে, শাহদাত ছাড়া অন্য কোন আমলে কেউ তাকে অতিক্রম করতে পারবে না। (বায়হাকী)

সৃষ্টিকুলের সাথে সদাচার : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : গোটা সৃষ্টিকুল আল্লাহর পরিবার। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহর পরিবারের সাথে সদয় ব্যবহার করে সে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয়। (বায়হাকী)

সদাচারের কিছু নমুনামাত্র তুলে ধরা হল। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এসব আরও বিস্তারিত জানার ও আমল করার তৌফিক দান করুন! আ-মী-ন।

No comments:

Post a Comment