তাকওয়া ভিত্তিক সামাজিক পরিশুদ্ধির সারমর্ম
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা'য়ালার জন্য যিনি রব্বুল আলামীন। দুরুদ ও সালাম রসূলুল্লাহ্ সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর
প্রতি যিনি রহমাতুল্লিল আলামীন, তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কিরাম
(রাদিয়াল্লাহু আনহুম) এবং সালেহীন (র)-গণের প্রতি। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই। আমরা আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ
(সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর বান্দাহ ও রসূল। নিশ্চয়ই শুভ পরিণতি শুধুমাত্র মুত্তাকীনদের জন্য নির্ধারিত।
মহল্লার অন্তর্গত পরিবারসমূহ যখন সাহাবাগণের (রা) পরিবারের ন্যায় আদর্শ পরিবার
হিসাবে গড়ে উঠবে তখন ঐ মহল্লা হবে মদীনাতুর রসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম)-এর ন্যায় তাকওয়া ভিত্তিক কল্যাণময় আদর্শ খিলাফাত সমাজ। আল্লাহর মহব্বত
অর্জনের জন্য সাধককে তাই আত্মশুদ্ধি ও পারিবারিক পরিশুদ্ধির সাথে সাথে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব,
পাড়া-প্রতিবেশীসহ সমাজে তাকওয়ার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যথাসাধ্য সাধনা
করতে হবে। আত্মীয়-স্বজন, পড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুমহল ও সমাজে তাকওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি না হলে নিজের কলব সুস্থ ও
রোগমুক্ত রাখা সম্ভব নয়। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
وَأَنْذِرْ
عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ ০ وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِمَنِ اتَّبَعَكَ
مِنَ الْمُؤْمِنِينَ ০ فَإِنْ عَصَوْكَ فَقُلْ إِنِّي بَرِيءٌ
مِمَّا تَعْمَلُونَ ০ وَتَوَكَّلْ عَلَى الْعَزِيزِ
الرَّحِيمِ ০
- আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করে দিন। যে সকল মুমিন আপনার
অনুসরণ করে সে সকল মুমিনদের প্রতি বিনয়ী হোন। তারা যদি আপনার অবাধ্যতা করে,
তাহলে তাদেরকে বলে দিন : ‘তোমরা যা কর তা থেকে
আমি দায়মুক্ত’। আপনি
মহাপরাক্রমশালী, অসীম দয়ালু আল্লাহর উপর ভরসা করুন। - (সূরা শুয়ারা : ২১৪ - ২১৭) পরামর্শ
হল-
১) আত্মীয়তা স্থাপন ও বন্ধু নির্বাচন : সাধককে আত্মীয়তা গড়ে তোলার ক্ষেেত্র
দুনিয়াবী ঐশ্বর্য ও পদমর্যাদার প্রতি খেয়াল না করে দ্বীনদারী পরিবেশের দিকে খেয়াল
রাখতে হবে। বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেেত্রও বন্ধুর দ্বীনদারীর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।
হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত- নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : কোন
ব্যক্তি তার বন্ধুর দ্বীনের অনুসারী হয়ে থাকে। কাজেই খেয়াল রাখা উচিত সে কেমন
বন্ধু নির্বাচন করছে। (আবু দাউদ ও তিরমিযী)
২) তা’লীমুল কুরআন মক্তব কায়েম : সাধককে দারুল আরকামের নমুনায় মহল্লায় তা’লীমুল কুরআন মক্তব কায়েম করে সহীহ তিলাওয়াতসহ অর্থ ও ব্যাখ্যা শিক্ষার
ব্যবস্থা করতে হবে। কুরআন ও ছুন্নাহ অনুযায়ী মহল্লাবাসীর জীবনের সার্বিক দিক গঠনের
প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের সর্বত্র তাকওয়ার পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করতে হবে।
৩) উম্মাহর উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন : মদীনাতুন্নবী (স) এর নমুনায় সমাজ সংশোধন
ও আদর্শ সমাজ গড়ে তোলার জন্য নবুওয়াতের নমুনায় দাওয়াত ও তাবলীগ, তা’লীম ও তারবিয়াত, তায্কিয়া বা পরিশুদ্ধি, পারিবারিক ও সামাজিক কল্যাণ এবং মানবতার কল্যাণ কার্যক্রমসমূহ বাস্তবায়নের
জন্য সাধককে মক্তব ভিত্তিক উম্মাহর উপর অর্পিত নবুওয়াতী দায়িত্ব পালন করতে হবে।
৪) দ্বীন শিক্ষা ও মেহনতের জন্য উৎসাহ প্রদান : মক্তবের মাধ্যমে নিররতা ও
অশিক্ষা দুর করে কুরআন ও শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার জন্য সবাইকে অনুপ্রাণিত
করতে হবে। মক্তবে তাফসীর, হাদীস ও কিতাবের একটি পাঠাগার গড়ে তুলে সবাইকে অধ্যয়নে
উৎসাহিত করতে হবে। সাধককে নিজ ও তার আত্মীয়-স্বজন-পাড়া-প্রতিবেশীদের প্রতি পরিবার
থেকে কমপেক্ষ একজন শিশুকে আলিম বানানোর জন্য উৎসাহিত করতে হবে। আত্মীয়-স্বজন ও
প্রতিবেশীদের প্রতি পরিবার থেকে অন্ততঃ একজন মুরব্বীকে দ্বীনের খেদমতের জন্য
মনোনীত করে দ্বীনের কাজের জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে।
৫) মহল্লাবাসীদের পরিশুদ্ধি আনয়ন : মহল্লাবাসীদের ঈমান কিভাবে মজবুত হবে এবং
র্শিক, কুফর, নিফাক, জাহালাত ও
তাগুতমুক্ত হবে; মক্তবে তার তা’লীম
দিতে হবে। আমল কিভাবে কুরআন-ছুন্নাহ্ মোতাবেক ইখলাসপূর্ণ হবে এবং রিয়া, কিব্র ও বিদআত মুক্ত হবে; তার শিক্ষা প্রদান করতে
হবে। শরীরের রক্ত-মাংস হারাম খাদ্যে কিভাবে কলুষিত হয় এবং হালাল খাদ্যে পবিত্র হয়-
উপমাসহ তার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। মহল্লাবাসীদের রূহ, কলব ও
নাফস কিভাবে পরিশুদ্ধ হবে, একজন সাধককে সে দিকে খেয়াল রেখে
তা’লীম দিতে হবে।
৬) দ্বীনি অনুশীলন ও কালচার : আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের পরিবারসমূহে দ্বীনি
দাওয়াত, তা’লীম, নসিহত ও অনুশীলন জারী
করে তাকওয়া ভিত্তিক জীবন গঠন ও কালচার গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা করতে হবে। তাদের নিজ
নিজ পরিবারে দৈনিক পারিবারিক তালিমের জন্য উৎসাহিত করতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে
আত্মীয়-স্বজন একত্রিত হলে তা’লীমের ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে
অনুষ্ঠানসমূহ আনন্দ-ফুর্তির বদলে দ্বীনি মাহফিলে পরিণত হবে।
৭) পারস্পরিক সহায়তা : আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের সবাইকে দ্বীনদার, তাকওয়াবান,
স্বাবলম্বী ও দারিদ্রমুক্ত করাসহ রোগে-শোকে ও বিপদে-আপদে সর্বদা
পারস্পরিক সহায়তার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। দারিদ্র বিমোচনে স্বল্পপুঁজির
কর্মসংস্থান, দরিদ্রদের শিক্ষা ও চিকিৎসা সাহায্য ইত্যাদি
কল্যাণমূলক কাজে সমাজের সবাইকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। সকল প্রকার অনৈতিকতা দুর করে
সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য সবাইকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ সামাজিক আন্দোলন গড়ার
চেষ্টা করতে হবে। যাবতীয় বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য পারস্পরিক সমঝোতা ও আপোষমূলক
নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ফতোয়াবাজী, বিতর্ক ও বাহাস
সর্বদা এড়িয়ে চলতে সবাইকে অনুপ্রাণিত করতে হবে।
হযরত আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ
সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের পার্থিব
কষ্টসমূহের একটি কষ্ট দুর করে দেয়, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার
একটি বড় কষ্ট দুর করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোন অভাবীর অভাবের কষ্ট লাঘব করে দেয়,
আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার অভাবের কষ্ট লাঘব করবেন। যে ব্যক্তি
কোন মুসলমানের দোষ গোপন রাখে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার
দোষ গোপন রাখবেন। বান্দা যতক্ষণ তার মুসলিম ভাইয়ের সাহায্য করতে থাকে আল্লাহও
ততক্ষণ তার সাহায্য করতে থাকেন। (ইমাম মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)
৮) সবাইকে দ্বীনপন্থী বানানো : আল্লাহওয়ালাগণের সাথে সাধককে ভক্তিপূর্ণ মহব্বত
রাখতে হবে, মতের অমিল হলেও হলেও তাদের সাথে কোন বিরোধে জড়ানো যাবে না। ইসলাম পন্থী
সকল ব্যক্তি, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও
দলের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে হবে। কোন দলপন্থী নয় বরং সবাই দ্বীনপন্থী বানাতে হবে। দল-মত
নির্বিশেষে সবাইকে আল্লাহর রজ্জু আল-কুরআনকে আঁকড়ে ধরতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং
তাগুতী, কুফরী, নিফাকী, শিরকী, জাহিলী, জালিমী ও
বিদআতী শক্তির সাথে সম্পর্ক না রাখার ব্যপারে অনুপ্রাণিত করতে হবে।
৯) সাম্প্রদায়িক নয় ধার্মিক বানানো : কুরআন ও ছুন্নাহর একনিষ্ঠ খাদেম ও
মুহাফিজ হিসাবে সমাজের সবাইকে গড়ে তোলার জন্য মক্তবে বিশেষ সাপ্তাহিক ও মাসিক
মাহফিলের ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে সর্বোত্তম ও শিণীয়
ব্যবহার করতে হবে। তাদের ধর্মীয় কাজ-কর্ম, আচার-আচরণের স্বাধীনতার প্রতি ল্য রেখেই
দাওয়াতে দ্বীনের কাজ চালাতে হবে। দল-মত নির্বিশেষে সবার ভাল কাজে সহযোগীতা ও খারাপ
কাজে অসহযোগীতা- নীতির ভিত্তিতে সমাজের সবার সাথে ইনসাফপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে
হবে।
১০) দ্বীন পরিপূর্ণভাবে গ্র্হণ : ইসলামের বিধান আংশিক মেনে চলার কোন সুযোগ নাই, বরং
পরিপূর্ণভাবে মেনে চলার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যেমন- মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ
- মুমিনগণ! তোমরা ইসলামের মধ্যে পুরোপুরি দাখিল হও এবং শয়তানের
পদাংক অনুসরণ কর না। নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট আদেশ
আসার পরও যদি তোমরা পথভ্রষ্ট হও, তাহলে জেনে রেখ! নিশ্চয়ই আল্লাহ
পরাক্রমশালী, মহাবিজ্ঞানী। (সূরা বাকারা : ২০৮-২০৯)
০ দোয়ার আমল : কুরআন ও ছুন্নাহর মোতাবেক বিশেষ দোয়ায় সামাজিক পরিশুদ্ধির
সাধনার পথে আল্লাহর রহমত ও সাহায্য পাওয়া যায়। যেমন-
رَبِّ
اشْرَحْ لِيْ صَدْرِيْ০ وَيَسِّرْ
لِيْ أَمْرِي ০ وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِّنْ لِّسَانِيْ ০ يَفْقَهُوا قَوْلِيْ০
- হে আমার রব! আমার ব প্রশস্ত করে দিন, আমার
কাজ সহজ করে দিন, আমার জিহ্বার জড়তা দুর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে। (সূরা ত্ব-হা : ২৫-২৮) মনে রাখবেন! দোয়া
অন্যতম হাতিয়ার।

No comments:
Post a Comment