Tuesday, June 3, 2014

সাবধান! ফতোয়াবাজদের থেকে সর্বদা দুরে থাকুন


সাবধান! ফতোয়াবাজদের থেকে সর্বদা দুরে থাকুন

বাংলাদেশের মুসলিম জনগণ সাধারণভাবে ধর্মপ্রান। এ দেশের মানুষ ইসলামের সোনালী পরশ লাভ করেছে মূলতঃ পীর-আউলিয়াদের মাধ্যমে। সময়ের ব্যবধানে ধারাবাহিক দ্বীনি তালীমের অভাবে কোথাও কোথাও কিছুটা বিচ্যুতি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সবার দায়িত্ব হল সে সব বিচ্যুতির ব্যাপারে কারো উলংগ সমালোচনা না করে বরং দ্বীনের সহীহ দৃষ্টিভংগি তুলে ধরে পজিটিভ আলোচনা করা। সত্যের আলোতে মিথ্যার অন্ধকার এমনিতেই দুরীভূত হয়ে যায়। মনে রাখবেন! সমালোচনা সংশোধনের পথ নয়, বরং সমালোচনা বিতর্কের জন্ম দেয়, বিতর্ক বিচ্ছেদের জন্ম দেয় আর বিচ্ছেদ নতুন ফিরকার জন্ম দেয়।

বর্তমানে মিডিয়া জগতে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক শ্রেনীর মুবাল্লিগ দেখা যায়, যারা সহীহ দ্বীন প্রচারের নামে ফতোয়াবাজীর মাধ্যমে মনের অজান্তে দ্বীনের মারাত্মক ক্ষতি করে চলছে। এদের একটি ফতোয়া হল- সকল পীরই ভন্ড। পীর-মুরিদী শিরক। ইসলামে কোন পীর-মুরিদী নাই এই ফতোয়ার মাধ্যমে তারা পীর-আউলিয়াদের সাথে যুগ যুগ ধরে এ দেশের মানুষের হৃদয়ের সুগভীর যোগসুত্রটি ধংস করে সাধারণ মানুষদেরকে পরোক্ষভাবে ইসলাম থেকেই দুরে সরিয়ে দিচ্ছে।

এদের আর একটি শ্লোগান হল-শুধু রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ করতে হবে, সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুম-গণেরও অনুসরণ করা যাবে না। যেমন, সমস্ত সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুম-গণের ঐক্যমতে প্রতিষ্ঠিত তারাবীহ সালাত ২০ রাকাত বাদ দিয়ে তারা হযরত আয়শা রাদিয়াল্লাহু আনহা-এর বর্ণিত হাদীসের ভিত্তিতে আট রাকাত তারাবীহ সালাত আদায় করেন। তাদের এই আট রাকাত আদায় হয়ত বিকল্প হিসাবে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু অগ্রহণযোগ্য বিষয় হল- সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুম-গণের ইজমা (ঐক্যমত)-কেও বিদআত আখ্যায়িত করা এবং শারীয়াতের দলিল মানতে অস্বীকার করা। অথচ তাঁরা রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাতের সর্বাধিক অনুসারী। রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং তাদের সুন্নাতকেও নিজ সুন্নাতের মর্যাদায় সত্যায়ন করেছেন।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : বানী-ইসরাইলীগণ বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল আর আমার উম্মাত বিভক্ত হবে তিয়াত্তর দলে, সকলেই জাহান্নামে যাবে কিন্তু একটি মাত্র দল জান্নাতে যাবে। সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেনঃ এই দল কারা? রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন : যারা আমার ও আমার সাহাবাগণের আদর্শের উপর কায়েম থাকবে। -(তিরমিজি-২৫৭৮ : হাসান, আবু দাউদ, সহীহ তারগীব-৪৮) 

একটি জরীপে দেখা গেছে- বাংলাদেশে শতকরা দশভাগ মুসলিম নিয়মিত নামাজী। আর অনিয়মিত বা জুম-ঈদ, শবেবরাত ও শবেকদর ইত্যাদি সিজনাল নামাজীর সংখ্যা আরও ১৫% এর মত। এরাও পূর্বে অনেকেই নিয়মিত নামাজী ছিল। ধীরে ধীরে নিয়মিত নামাজীর সংখ্যা আরও হ্রাস পাচ্ছে। যারা নামাজ আদায় করেন তারা কোন না কোন পীর-মাশায়েখ, ইসলামী দল, ইসলামী ব্যক্তিত্ব, ইসলামী প্রতিষ্ঠান বা ফিরকার দ্বারা অনুপ্রাণিত বা প্রভাবিত। উল্লেখিত ফতোয়াবাজ মুবাল্লিগগণ নিজেদেরকেই একমাত্র সহীহ  হাদীসপন্থী বলে আখ্যায়িত করেন আর বাকী সবাইকে তাকলীদপন্থী, ভন্ড, গোমরাহ, বিদআতী ইত্যাদি লকবে আখ্যায়িত করে নামাজীদেরকে তাদের দ্বীনি সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। আর এই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে মুসলমানদের মাসজিদের সাথে সম্পর্ক ও নামাজীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। 

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, নিয়মিত নামাজীর সংখ্যা গড়ে শতকরা দশ জন। এই নিয়মিত নামাজীদের মধ্যে জরীপে প্রাপ্ত তথ্য আরো দুঃখজনক। এদের মধ্যে গড়ে (বিভিন্ন ইনডিকেটরে কিছুটা ব্যবধান রয়েছ) প্রায় শতকরা নব্বই জনের অবস্থা এরূপ যে, কুরআন শরীফ সহীহভাবে তিলাওয়া করতে পারে না, ঈমান-আকিদার মৌলিক বিষয়াদি সম্পর্কে সচ্ছ ধারণার অভাব রয়েছে, খাস পর্দা পালনের ব্যাপারে ঘাটতি রয়েছে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুদের সাথে সম্পর্ক রয়েছ.. ইত্যাদি। আর বাকী শতকরা দশ জন মোটামুটি সচেতন। তার মানে মোটামুটি সচেতন মুসলিমের সংখ্যা হল প্রতি হাজারে একজন মাত্র।

দ্বীনের মুয়াল্লিম ও মুবাল্লিগগণের দায়িত্ব ছিল, যারা অনিয়মিত নামাজী তাদেরকে নিয়মিত নামাজী বানানোর জন্য নসিহত করা, যারা নিয়মিত নামাজী তাদের ঘাটতিগুলো পুরণ করে সচেতন মুসলিম হিসাবে গড়ে তোলার জন্য তালীমের ব্যবস্থা করা। কিন্তু উল্লেখিত ফতোয়াবাজ মুবাল্লিগগণ এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাদ দিয়ে নামাজে কোথায় হাত বাধতে হবে, সূরা ফাতিহার পর আমীন জোরে না আস্তে বলতে হবে- এ ধরনের সাধারণ ও বিতর্কিত বিষয়াদি নিয়ে ফতোয়াবাজী ও ফিতনাবাজী করে মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করে চলছে। অথচ যে সব বিষয় নিয়ে তারা বিতর্ক তুলছে তা সবগুলোই সহীহ হাদীসের উপর প্রতিষ্ঠিত সাহাবাদের যামানা থেকে অদ্যাবধি মুসলিম উম্মাহর মাঝে যুগ যুগ ধরে আমলকৃত সুন্নাত।

মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন দল, তরিকা ও ফিরকার আরও কিছু ফতোয়াবাজের পদচারণা পরিলক্ষিত হচ্ছে। যারা দ্বীনের প্রচার ও প্রসারের পরিবর্তে ফতোয়াবাজীর মাধ্যমে নিজের দল ও দলনেতা, নিজের তরিকা ও তরিকার শায়েখ, নিজের ফিরকা ও ফিরকার বৈশিষ্ট ইত্যাদি- এর প্রচার ও প্রসারের তৎপরতায় লিপ্ত। তারা মুসলমানদের দ্বীনপন্থি বানানোর পরিবর্তে দলপন্থি বানানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ফতোয়াবাজী, কুৎসা রটনা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির মাধ্যমে তারা অন্যান্যদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করে নিজেদেরকেই একমাত্র সহীহ জামাত বা একমাত্র নবীওয়ালা কাজ হিসাবে উপস্থাপন করার অপপ্রায়াস চালাচ্ছে। অথচ আল্লাহ তায়ালা সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে তাঁর মহান দ্বীনকে ও আলকুরআনকে ধারণের নির্দেশ দিয়েছেন।

সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুম-গণের যামানায় সীফফীনের যুদ্ধের পর সালিসীকে কেন্দ্র করে সর্বপ্রথম এ ধরণের একটি ফতোয়াবাজ ও ফিতনাবাজ দলের উদ্ভব হয়- যারা নিজেদেরকে একমাত্র সহীহ জামাত হিসাবে গণ্য করত, হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং তাদের অনুসারীদেরকে গোমরাহ মনে করত, তাদের হত্যা করা সওয়াবের কাজ মনে করত অথচ তারা ইবাদাত-বন্দগীতে অন্যদের তুলনায় অগ্রণী ছিল। তারা যতই ইবাদাতগুজার হোক না কেন, উম্মাহর উলামাগণের সম্মিলিত মতে তারা মহান দ্বীন ইসলাম থেকে বহিস্কৃত খারেজী নামে আখ্যায়িত।


হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং পরবর্তীতে হযরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের মূলোৎপাটন করেন। কিন্তু তাদের সেই ধ্যান-ধারণা উম্মাহর কতিপয় কুলাংগার যুগে যুগে লালন করে আসছে। আজও যারা নিজেদেরকে একমাত্র সহীহ জামাত হিসাবে মনে করে আর অন্যান্যদেরকে গোমরাহ মনে করে তারা যতই আমলদার আর ইবাদাতগুজার হোক না কেন, আসলে তারা ইসলাম থেকে বহিস্কৃত সেই খারেজীদের উত্তরসুরী। মুসলমানদেরকে অবশ্যই তাদের বিষাক্ত ছোবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। তাদের মুখরোচক প্রচার প্রপাগান্ডার থেকে সর্বদা দুরে থাকতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে কুরআন ও ছুন্নাহ আকড়ে ধরার তৌফিক দিন! আ-মী-ন।

No comments:

Post a Comment