Friday, June 27, 2014

ইসলামে পোষাক-পরিচ্ছদের নীতিমালা


ইসলামে পোষাক-পরিচ্ছদের নীতিমালা


মানব জীবনে পোষাক-পরিচ্ছদ ব্যবহারের উদ্দেশ্য প্রসংগে মহান আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ হে আদম সন্তান! আমি তোমাদের জন্য ব্যবস্থা করেছি পোশাকের, যা আবৃত করে তোমাদের লজ্জাস্থান। আরও ব্যবস্থা করেছি সাজ-সজ্জার উপকরণের। বস্তুত তাকওয়ার পোশাকই সর্বোত্তম পোশাক। এসব আল্লাহর কুদরতের অন্যতম নিদর্শন, যাতে মানুষ উপদেশ গ্রহণ করে-(সূরা আরাফ : ২৬)।

উক্ত আয়াতে পোশাকের দুটি উপকারিতা বর্ণিত হয়েছে- ১. লজ্জাস্থান আবৃত করা এবং ২. সাজ-সজ্জাএরপর বলা হয়েছে- তাকওয়ার পোশাকই সর্বোত্তম পোশাক। তাকওয়ার পোষাক হল ঐ সব পোষাক যা মানুষের অন্তরে আল্লাহভীতি জাগ্রত করে এরং আল্লাহর দিকে রুজু করে।

১. সতর ঢাকাঃ পোশাকের প্রধান ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য সতর ঢাকা। এই সতর ঢাকা ঈমানের পর সর্বপ্রথম ফরয। তাই পোশাক অবশ্যই সতর আবৃতকারী হতে হবে। উপরে বর্ণিত কোরআন মাজীদের আয়াতের যা আবৃত করে তোমাদের লজ্জাস্থানব্যাক্যাংশে এই মূলনীতির দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। 
(
মাআরিফুল কোরআন : ৩/৫০৮-৫০৯)।

পুরুষের নাভি থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত আর নারীর মুখমন্ডল, টাখনু থেকে নিচের অংশ ও কব্জির নিচের অংশ ছাড়া গোটা শরীর আবৃত রাখা ফরয। ফিতনার আশংকা থাকলে পরপুরুষের সামনে মুখমন্ডলসহ গোটা শরীর আচ্ছাদিত রাখা জরুরি। অতএব পোশাকের মাধ্যমে যাতে এই প্রয়োজন পূরণ হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা অপরিহার্য। এ প্রসংগে মহান আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ

-“মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গর হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন।ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।”  -{সূরা নূর-৩০-৩১}

তিনি আরও বলেনঃ "হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিনদের স্ত্রীদেরকে বল, তারা যেন তাদের জিলবাবের কিছু অংশ নিজেদের উপর ঝুলিয়ে দেয়। তাদেরকে চেনার ব্যাপারে এটাই সবচেয়ে কাছাকাছি পন্থা হবে। ফলে তাদেরকে কষ্ট দেয়া হবে না। আর আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়াময়।" -[সূরা আহযাবঃ ৫৯]


শরীরের সৌন্দর্য্য প্রকাশ পায় এমন পাতলা বা শরীরের সাথে লাগানো পোষাক নিষিদ্ধঃ হযরত আবূ  হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ জাহান্নামবাসী দুটি দল রয়েছে। যাদেরকে আমি এখনো দেখিনি। একদল এমন লোক যাদের হাতে গরুর লেজের মত লাঠি থাকবে যা দিয়ে তারা লোকদেরকে প্রহার করবে। আর অন্য দল এমন নারী যারা পোশাক পরেও উলঙ্গ থাকে। তারা অন্যদের তাদের প্রতি আকৃষ্ট করবে নিজেরাও অন্যদের প্রতি ঝুঁকবে। তাদের মস্তক উটের পিঠের কুঁজের মত হবে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এমনকি জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ এর ঘ্রাণ এত এত দূর থেকেও পাওয়া যায়।’ - [মুসলিম : হাদীস নং ২১২৮]

হযরত উসামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে একটি কুবতী (এক ধরনের সাদা পাতলা কাপড়) চাদর হাদিয়া দিলেন। আমি তা আমার স্ত্রীকে দিয়ে দিলাম। একদিন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে বললেন, ‘তুমি সেই কুবতী চাদরটি পরো না কেন? আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! চাদরটি আমার স্ত্রীকে দিয়ে দিয়েছি। তখন নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তোমার স্ত্রীকে বলবে সে যেন কাপড়টির নিচে আরেকটি কাপড় ব্যবহার করে। কেননা ঐ কাপড়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আকার-আকৃতি ফুটে উঠার সম্ভাবনা রয়েছে। (মুসনাদে আহমাদঃ হাদীস- ৫/২০৫, তবারানীঃ হাদীস- ৩৭৬, কানযুল উম্মালঃ হাদীস- ৪১৯৩০, ৪১৯৩১)

২। সাজ-সজ্জাঃ পোষাক হবে ভারসাম্যপূর্ণ, সাধ্যের মধ্যে রুচিশীল,পরিচ্ছন্ন বিলাসিতার জন্য অপচয় এবং কৃপনতা সর্বক্ষেত্রেই নিন্দনীয়। প্রয়োজন ও সামর্থ্য এবং সাধ ও সাধ্যের মাঝে ভারসাম্য বজায় রেখে চলাই কল্যাণের ধর্ম ইসলামের নির্দেশনা। পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রেও তা যথাযথ প্রযোজ্য।

বিলাসিতা বা শখের বশে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বা সীমাতিরিক্ত উচ্চমূল্যের কিংবা সাধ্যের বাইরের মূল্যের পোশাক ক্রয় করা ইসলামে নিষেধ। বিশেষ বিশেষ সময়ে পরিধানের জন্য সাধ্যের ভেতরের মূল্যবান পোশাক থাকা দূষণীয় নয়। তবে তা কখনো অপচয়ের আওতাভুক্ত না হওয়া চাই। কারণ প্রসংগে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন : নিশ্চয় অপচয়কারীগণ শয়তানের সহযোগী- [সূরা বনী ইসরাঈল : ২৭]

আবার পোষাকের ব্যপারে কৃপনতা অবলম্বনও সমিচীন নয়। কারণ, কৃপনতা প্রসংগে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেন : ‘আর যে ব্যক্তি কৃপণতা করে ও বেপরওয়া হয় এবং উত্তম বিষয়কে মিথ্যা মনে করে আমি তাকে কষ্টের বিষয়ের (দোযখের) জন্য সহজ পথ দান করব।’-(সূরা আল-লাইল : ৮-১০)

পোষাক হবে ভারসাম্যপূর্ণ উত্তম পোষাকঃ হযরত আবুল আহওয়াস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি মহানবীর দরবারে এলাম। তখন আমার পরনে ছিল অতি নিম্নমানের কাপড়। এটা দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি সম্পদ আছে? আমি বললাম জ্বী, আমার সম্পদ আছে। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কি কি সম্পদ আছে? আমি বললাম, উট, গরু, ছাগল, ঘোড়া, গোলাম ইত্যাদি সবধরনের সম্পদই আল্লাহ আমাকে দান করেছেন। তখন তিনি বললেন, যখন আল্লাহ তোমাকে সম্পদ দিয়েছেন তখন তোমার উপর তাঁর নিয়ামতের নিদর্শন থাকা চাই। -(আবু দাউদঃ ২/৫৬২, তিরমিযীঃ ২/১০৯ ও নাসাঈঃ ২/২৫২)

অন্য বর্ণনায় এসেছেঃ রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেছেনঃনিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা তার বান্দার উপর তার দেয়া নিয়ামতের নিদর্শন দেখতে পছন্দ করেন।’ (তিরমিযীঃ ২/১০৯)

হযরত জাবির (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেছেনঃ “তোমরা জুলুম থেকে বেঁচে থাক। কেননা জুলুম কিয়ামত দিবসে চরম অন্ধকার রূপ ধারণ করবে। তোমরা কৃপণতা থেকেও বেঁচে থাক। কারণ এই কৃপণতাই তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিকে ধ্বংস করেছে এবং প্ররোচিত করেছে রক্তপাত করতে ও নিষিদ্ধ বস্তুকে হালালে পরিণত করতে।" -(মুসলিমঃ হাদীস নং ২৫৭৮)

পোশাক হতে হবে পরিচ্ছন্ন ও শালীনঃ হযরত সাহল ইবনে হানজালিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, (কোন এক সফর হতে ফেরার পথে) রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম প্রিয় সাহাবীগণকে লক্ষ্য করে বললেন : ‘তোমরা তোমাদের ভাইদের নিকট আগমন করেছে। কাজেই তোমাদের সাওদাগুলো গুছিয়ে নাও আর পোশাক পরিপাটি করে নাও। যেন তোমাদেরকে মানুষের ভিড়ে দেখতে তিলকের ন্যায় সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন মনে হয় (জেনে রেখো) স্বভাবগত নোংরামী বা ইচ্ছাকৃত নোংরামী কোনটাই আল্লাহ পছন্দ করেন না-(আবু দাউদ : ৭০৮৩)।

অন্য এক হাদিসে আছে- একদা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম মসজিদে বসা ছিলেন, ইতিমধ্যে এক লোক মসজিদে প্রবেশ করল, যার চুল ও দাড়িগুলো ছিল এলোমেলো। মহানবী (স.) তাকে হাতের ইশারায় পরিপাটি হয়ে আসতে বললেন, তিনি পরিপাটি হয়ে এলেন। নবীজি তখন বললেন, কেউ মাথার চুল এলোমেলো করে সাক্ষাৎ শয়তানের মতো উপস্থিত হওয়ার চেয়ে এখনকার বেশটি উত্তম নয় কি? (মুয়াত্তা মালেক : ২/২৬২)।

হযরত জাবির (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম আমাদের নিকট এলেন, তখন এক ব্যক্তির মাথার চুল ছিল এলোমেলো। এটা দেখে তিনি বললেন : ‘এই লোকের কি এমন কিছু নেই, যা দিয়ে সে তার মাথা পরিপাটি করবে’? অন্য এক ব্যক্তিকে ময়লা কাপড় পরিহিত দেখে বললেন, ‘এর কি এমন কিছু নেই যা দিয়ে তার কাপড় ধৌত করবে-(আবু দাউদঃ : ২/৫৬২)

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, পথে-ঘাটে, মাজার-দরগায় একশ্রেণীর লোক দেখা যায়, যারা থাকে অত্যন্ত নোংরা ও অপরিচ্ছন্ন। মাথায় থাকে চুলের জট্, গায়ে থাকে ছালার চট্, শরীর থেকে বের হয় উৎকট দুর্গন্ধ। এই নোংরামীকেই এরা মনে করে দীনদারী ও বুজুর্গী। মনে রাখবেন! এর সাথে দীনে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। আমাদের নবী কঠোর ভাষায়এসব নোংরামীর প্রতিবাদ করেছেন।

এ প্রসঙ্গে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গবেষক আল্লামা মানাযির আহসান গিলানীর (রহ.) বলেন, যেসব লোক ইসলামের নন্দিত ও বরণীয় পূর্বপুরুষগণের বদনাম করতে বসেছে, তাদেরকে সাহস করে এ কথাটি জানিয়ে দিবেন, এলোমেলো দাড়ি, উষ্ক-খুষ্ক বিক্ষিপ্ত কেশ আর বেঢঙ্গ লেবাসকে যে তারা ধর্মীয় সূরত সাব্যস্ত করেছেন, ধর্মের সবচেয়ে বড় শিক্ষক মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম -এর দৃষ্টিতে তা ছিল ধর্মহীনতার আলামত। -(ইসলামী মাআশিয়াত : ২৩)

তাকওয়ার পোশাকঃ তাকওয়ার পোষাক হল ঐ সব পোষাক যা মানুষের অন্তরে আল্লাহভীতি জাগ্রত করে এরং আল্লাহর দিকে রুজু করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকওয়ার পোষাক হিসাবে কোন বিশেষ পোষাক নির্ধারণ করেন নাই। তবে তিনি কিছু কিছু পোষাক উম্মাতের জন্য নিষিদ্ধ করেছেন, সে সব পোষাক পরিহার করা তাওয়ার অন্তর্গত। আবার বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে আল্লাহর বন্ধুগণ এবং কিছু কিছু পোষাক পরিধান করা উত্তম অভ্যাস হিসাবে গণ্য করেছেন,আল্লাহ তায়ালার মহব্বতে সে সব পোষাকসমুহ উত্তম হিসাবে গ্রহণ করাও তাকওয়ার পোষাকের অন্তর্ভূক্ত।

যে সব পোষাক তাকওয়ার পরিপন্থি ও সর্বদা বর্জনীয়ঃ (১) পুরুষদের জন্য টাখনুর নীচে কাপড় ঝুলিয়ে পরিধান করা, (২) বিজাতীয় সভ্যতার পোষাক, (৩) প্রদর্শনীয় পোষাক, (৪) নারী-পুরুষের সাদৃশ পোষাক ও (৫) পুরুষদের জন্য রেশমী বস্ত্র ও সর্ণালংকার ইত্যাদি মারাত্মক ধ্বংসাত্মক এবং সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য। এ সব পোষাক মানব সমাজকে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত করে। এগুলো থেকে আত্মরক্ষা করা সর্বদা সবার জন্যই একান্ত অপরিহার্য বিষয়।

টাখনুর নীচে কাপড় ঝুলিয়ে পরিধান করা পুরুষদের জন্য নিষিদ্ধঃ হযরত আবু যর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : “কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তিন ব্যক্তির সাথে কথা তো বলবেনই না বরং তাদের দিকে তাকিয়েও দেখবেন না। এমনকি তিনি তাদেরকে গুনাহ থেকে পবিত্র করবেন না বরং তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তারা কারা? তবে এরা তো ধ্বংশ, তাদের বাঁচার কোন রাস্তা নাই। রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম- এ কথা তিনবার বলেছেন। তারা হলঃ ১) যে ব্যক্তি টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে কাপড় পরে, ২) যে ব্যক্তি মিথ্যা কসম খেয়ে ব্যাবসার পণ্য বিক্রি করে এবং ৩) যে ব্যক্তি কারো উপকার করে আবার খোটা দেয়। -(মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ ও ইব্‌ন মাজাহ্‌)

হযরত জাবের ইব্‌ন সুলাইম (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে কাপড় পড়ার ব্যাপারে সাবধান হও। কারণ, তা অহংকারের অন্তর্ভূক্ত। আর আল্লাহ অহংকার করাকে পছন্দ করেন না।” -(আবু দাঊদ)

হযরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ টাখনুর নিচের যে অংশ পায়জামা বা লুঙ্গী দ্বারা ঢাকা থাকে তা জাহান্নামে যাবে। -{সহীহ বুখারীঃ হাদীস নং-৫৭৮৭, ৫৪৫০, সুনানে নাসায়ীঃ হাদীস নং-৫৩৩১}

বিজাতীয় পোশাক পরিধান করা নিষিদ্ধঃ জীবনযাত্রার সব ক্ষেত্রেই স্বকীয়তা বজায় রাখা উচিৎ। কোন আত্মমর্যাদাশীল জাতি নির্বিচার পরানুকরণের শিকার হতে পারে না। সে মতে লেবাস পোশাকের ক্ষেত্রেও বিজাতির অন্ধ অনুকরণ থেকে বেঁচে থাকা অপরিহার্য। যে ধরনের পোশাক বিজাতীয় পোশাক হিসেবে পরিচিত, সে ধরনের পোশাক পরা শরীআতে নিষিদ্ধ।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে সামঞ্জস্য বা মিল রাখে, সে তাদেরই দলভুক্ত এবং তার হাশর-নশর তাদের সাথেই হবে” -(মুসনাদে আহমদ)

হযরত আবু উমামা বাহেলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের কৃষ্টি-কালচারের অনুকরণ করবে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত গণ্য হবে এবং যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়কে মহব্বত করবে, তাদের সাথে তার হাশর হবে।” -(সুনানে আবু দাউদঃ হাদীস নং ৩৫১৪)

অন্য বর্ণনায়ঃ রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা পথ-পন্থা, রীতি-নীতি, চাল-চলন ও লেবাস-পোশাকে পৌত্তলিকদের প্রতিকূলে চলো; অনুকূলে নয়। (বুখারীঃ হাদীস নং ৫৮৯)

প্রসিদ্ধি বা মানুষের দৃষ্টি আকর্শনের জন্য খুব জাঁকজমকপূর্ণ ব্যাতিক্রমী পোশাক পরিধান করাও নিষিদ্ধঃ হাদীসে শরীফে এসেছে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি দুনিয়াতে প্রসিদ্ধির পোশাক পরবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে লাঞ্ছনা ও আগুনের পোশাক পরিধান করাবেন। -(আবু দাউদঃ হাদীস নং ২/৫৫৮; ইবনে মাজাহঃ হাদীস নং ২৫৭)

পুরুষ ও নারীদের পোষাকের ভিন্নতাঃ পুরুষের পোশাক পুরুষোচিত আর নারীর পোশাক নারীর উপযোগী হওয়া একান্ত কাম্য। স্বভাবগতভাবেই পুরুষকে দেয়া হয়েছে শক্তি ও দৃঢ়তা। কারণ তার কর্মক্ষেত্র হলো বাইরের জগত। পক্ষান্তরে নারী হলো কোমল ও কোমনীয়। মাতৃত্বের মমতা ও নারীত্বের লাজ, নম্রতাই নারীর সৌন্দর্য। তাই ইসলামী শরীআত নারী-পুরুষের জন্য ব্যবস্থা করেছে ভিন্ন ভিন্ন পোশাকের। আজকাল অনেক নারীকে দেখা যায় প্যান্ট, টি-শার্ট ইত্যাদি পরতে। আবার অনেক পুরুষকে দেখা যায় হাতে চুড়ি, কানে দুল, গলায় চেইন ব্যবহার করতে। অতএব পুরুষের পোশাক নারী কিংবা নারীর পোশাক পুরুষ পরিধান করে সাদৃশ্যতা গ্রহণ করা হারাম ও কবীরা গুনাহ। হাদীসে এসেছে-

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ 'আল্লাহ্তা'আলা সেই সব মহিলাদের উপর অভিশাপ করেছেন যারা পুরুষের বেশ ধারণ করে এবং সে সকল পুরুষদের উপর অভিশাপ যারা মহিলাদের বেশ ধারণ করে- (বুখারী, মিশকাত হা/৪৪২৯, বাংলা ৮ম খণ্ড হা/৪২৩২)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই সব পুরুষের উপর লানত করেছেন, যারা নারীদের সাদৃশ্য গ্রহণ করে (তাদের মতো আকৃতি, তাদের পোশাক ও তাদের চাল-চলন গ্রহণ করে); আর সেই সব নারীর উপরও লানত করেছেন, যারা পুরুষের সাদৃশ্য গ্রহণ করে। - [সহীহ বুখারী]

হযরত আবূ হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই পুরুষের ওপর অভিশাপ করেছেন যে, মহিলার পোষাক পরিধান করে এবং সে মহিলার উপর অভিশাপ করেছেন যে পুরুষের পোষাক পরিধান করে -(আবূদাঊদ, মিশকাতঃ হা/৪৪৬৯)

হযরত ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজড়ার বেশ ধারণকারী পুরুষের উপর অভিশাপ করেছেন এবং পুরুষ বেশ ধারণকারী নারীর উপর অভিশাপ করেছেন (বুখারী, মিশকাত হা/৪৪২৮)

হযরত ইবনু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ 'তিন শ্রেণীর লোক জান্নাতে যাবে না- ১. পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, ২. বাড়ীতে বেহায়াপনার সুযোগ প্রদানকারী ও ৩. পুরুষের বেশ ধারণকারী নারী' -(নাসাঈঃ ছহীহ্‌)

আবূ মুলায়কা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা-কে বলা হল- একটি মেয়ে পুরুষের জুতা পরে। তখন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষের বেশধারী নারীর প্রতি অভিশাপ করেছেন- [আবূদাঊদ, মিশকাতঃ ৪৪৭০]

স্বর্ণালংকার ও রেশমি বস্ত্র পরিধান পুরুষের জন্য নিষিদ্ধঃ হযরত যায়েদ ইবনু আকরাম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ স্বর্ণ ও রেশমি বস্ত্র আমার উম্মতের নারীদের জন্য বৈধ এবং পুরুষের জন্য হারাম।’ -(সিলসিলা ছাহীহাঃ ১৮৬৫/৩০৩০)

হযরত বারাআ ইবনে আযিব থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্  সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সাতটি বিষয় করতে এবং সাতটি বিষয় না করতে নির্দেশ দিয়েছেন : তিনি আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন : রোগীর খোঁজ-খবর নিতে, জানাযায় অংশগ্রহণ করতে, হাঁচির জবাব দিতে, শপথ বা প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করতে, মাজলুমের সাহায্য করতে এবং সালামের ব্যাপক প্রচলন করতে। তিনি আমাদেরকে নিষেধ করেছেন : স্বর্ণের আংটি পরিধান ও তৈরী করতে, রূপার পাত্রে পান করতে, লাল রং এর রেশমের গদিতে বসতে, কাচ্ছি (কাপড়), রেশমীবস্ত্র ও দীবাজ পরিধান করতে। -(বুখারী ও মুসলিম)

হলুদ বর্ণের পোষাক নিষিদ্ধঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার গায়ে হলুদ বর্ণের দুটো কাপড় দেখে বললেনঃ “এটা কাফিরদের পোষাক, কাজেই তুমি তা পরিধান করো না।”-[সহীহ মুসলিমঃ ৫২৭৩]

হযরত আলি ইবনে আবি তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে রুকু অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত, স্বর্ণালঙ্কার ব্যবহার ও হলুদ বর্ণের পোষাক পরিধান করতে নিষেধ করেছেন।”-[সহীহ মুসলিমঃ ৫২৭৬]

পরচুলা পরিধান ও শরীরে উল্কি অঙ্কনঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। যে মহিলা পরচুলা লাগিয়ে দেয় এবং যে পরচুলা লাগাতে বলে, আর যে মহিলা অঙ্গ প্রত্যঙ্গে উল্কি উৎকীর্ণ করে ও উল্কি উৎকীর্ণ করতে বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে অভিশাপ করেছেন। -[সহীহ বুখারী ৫৯৩৭, ৫৯৪০, ৫৯৪২, ৫৯৪৭]

তাকওয়ার উত্তম পোষাকঃ হযরত ইবনে আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ "তোমরা কাপড়গুলি থেকে সাদা কাপড় পরিধান কর। কারণ তোমাদের কাপিড়গুলির মধ্যে সাদা সর্বোত্তম। আর সাদা কাপড়েই তোমাদের মৃতদের কাফন দাও।" -(আবূ দাউদঃ পোশাক অধ্যায়, তিরমিযী- হাসান ও সহীহ, জানাযা অধ্যায়)

পোশাক পরিধানে শুকরিয়া আদায়ঃ আল্লাহর পোশাক মহামহিম আল্লাহর তাআলার এক বিশেষ নিয়ামত। তাই তা পরিধানের সময় পরিধানের দুআ পাঠ করে তার শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম নতুন পোশাক পরলে বলতেন- আল্লাহুম্মা লাকাল হামদু আন্তা কাসাওতানী হাযা নাস্আলুকা খায়রাহু ওয়া খায়রা মা ছুনিআ লাহু ওয়া আউযুবিকা মিন শার্রিহী ওয়া শার্রি মা ছুনিআ লাহু-(তিরমিযীঃ ১৭৬৭; আবু দাউদঃ ৫৫৮)


আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে তাঁর দ্বীনের খেদমতের জন্য কবুল করুন! রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম)-গনের আদর্শের উপর সর্বদা কায়েম রাখুন! তাঁদের বরকতময় জামাআতের সংগে আমাদের হাশর করুন! আ-মী-ন।

No comments:

Post a Comment