Saturday, May 31, 2014

পারিবারিক জীবনে সন্তানের অধিকার


পারিবারিক জীবনে সন্তানের অধিকার

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা'য়ালার জন্য যিনি রব্বুল আলামীনদুরুদ ও সালাম রসূলুল্লাহ্ সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি যিনি রহমাতুল্লিল আলামীন, তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কিরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) এবং সালেহীন (র)-গণের প্রতিআমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাইআমরা আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর বান্দাহ ও রসূলনিশ্চয়ই শুভ পরিণতি শুধুমাত্র মুত্তাকীনদের জন্য নির্ধারিত।

আল্লাহ তাআলা পারিবারিক জীবনকে সন্তান-সন্তুতির মাধ্যমে ভারসাম্যপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় করেছেন। যাদেরকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সন্তান দান করেছেন তাদের উপর এক মহান দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। প্রতিটি মানব সন্তানই আল্লাহ তা’য়ালার অলংঘনীয় ফিতরাত তথা ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে। সন্তানকে আদর্শবান ও সচ্চরিত্রবান মুলিম হিসাবে গড়ে তোলা মাতা-পিতার উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানত ও অন্যতম দায়িত্ব। যেমন-

হযরত আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : প্রতিটি সন্তানই ইসলামী ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে থাকে।এরপর তার মাতাপিতা তাকে ইয়াহুদী, নাসারা অথবা অগ্নিপূজক বানিয়ে ফেলে, যেভাবে চতুস্পদ জন্তু একটি পরিপূর্ণ জন্তুই জন্ম দিয়ে থাকে।তোমরা এতে কোন কমতি দেখতে পাও কি? তারপর তিনি তিলাওয়াত করলেন: তুমি একনিষ্ঠ ভাবে নিজেকে ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখএটাই আল্লাহর ফিতরাত, যার উপর তিনি মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেনআল্লাহর সৃষ্টির রহস্যে কোন পরিবর্তন নেইএটাই সরল ধর্মকিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না-সূরা রুম আয়াত নং-৩০ -[বুখারী ও মুসলিম]

আমাদের সমাজ ব্যবস্থা দিন দিন যেভাবে অপসংস্কৃতি, অনৈতিকতা, বেহায়াপনা এবং চরিত্র বিধ্বংসী পরিবেশের দিকে ধাবিত হচ্ছে, সেখানে আমাদের সন্তানের উপর যেসব দায়িত্ব আছে তা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করতে হবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত পন্থায় সন্তানকে লালন-পালন করা ঈমানের অন্যতম দাবী। আমাদের উপর সন্তানদের যে অধিকার রয়েছে তার কিছু অধিকার এখানে আলোচনা করা হলো-

অনাগত  সন্তানদেরকে শয়তান থেকে হিফাজত করার ব্যবস্থা গ্রহনঃ পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল- অনাগত সন্তানদেরকে শয়তান থেকে হিফাযতের জন্য শুরু থেকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা। যেমন-

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তোমাদের কেউ যখন তার স্ত্রীর কাছে আসে, তখন তার নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়া উচিৎ-

بِسْمِ اللّهِ اَللّهُمَّ جَنِّبْنَا الشَّيْطَانَ وَجَنِّبْ الشَّيْطَانَ مَا رَزَقْتَنَا

(আল্লাহ নামে শুরু করছি। হে আল্লাহ! শয়তান থেকে আমাদের দুরে রাখ এবং শয়তান থেকে দুরে রাখ যা আমাদেরকে দান করা হবে) এই মিলনের ফলে যদি কোন সন্তান জন্ম নেয় তাহলে শয়তান তার কোন ক্ষতি করতে পারে না। -(ইমাম বুখারী ও মুসলিম হাদীসটি সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন)

কানে আযান দেয়াঃ সন্তান দুনিয়াতে আসার পর গোসল দিয়ে পরিষ্কার করে তার ডান কানে আযান দেয়া, তা ছেলে হোক বা মেয়ে হোক। পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল শিশুর কানে সর্বপ্রথম আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের আওয়াজ পৌঁছে দেয়া এবং ওঁত পেতে থাকা শয়তান যাতে তার কোন ক্ষতি না করতে পারে। যেমন হাদিসে এসেছে- 

হযরত আবূ রাফে রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্‌ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাসান ইবনে আলীর কানে আযান দিতে দেখেছি। –[ সুনান আবূ দাউদ-  [৫১০৫

তাহনীক করাঃ পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সন্তানের জন্য তাহনীক করা এবং বরকতের জন্য দোআ করা। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদেরকে খেজুর দিয়ে তাহনীক করতেন এবং বরকতের জন্য দোআ করতেন। [সহীহ বুখারী: ৩৯০৯ ও মুসলিম: ২১৪৬]

সুন্দর নাম রাখাঃ পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সন্তানের জন্য সুন্দর নাম নির্বাচন করা নাম অর্থবহ হওয়া নামের সৌন্দর্য। কেননা জীবনে নামেরও একটি তাসীর আছে। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক অসুন্দর নাম পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। -[আবু দাউদঃ ৪৯৫২, ৪৯৬১]

সন্তানের আক্বিকা করাঃ ইসলামী সংস্কৃতির অন্যতম বিষয় হলো সন্তানের জন্য আকীকা করা। পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সন্তানের জন্য আকীকা করা। ছেলের পক্ষ থেকে ২টি ছাগল এবং মেয়ের পক্ষ থেকে ১টি ছাগল আল্লাহর নামে যবেহ করা। এ প্রসংগে হাদীসে এসেছে-

হযরত সামুরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সকল নবজাতক তার আক্বিকার সাথে আবদ্ধ। জন্মের সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে জবেহ করা হবে। ঐ দিন তার নাম রাখা হবে। আর তার মাথার চুল কামানো হবে। - [সুনান আবূ দাউদ: ২৮৩৮] 

সন্তানের জন্য সদকাহ করাঃ পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সন্তানের জন্য সদকাহ করা ছেলে হোক বা মেয়ে হোক সপ্তম দিবসে চুল কাটা এবং চুল পরিমাণ রৌপ্য সদকাহ করা সুন্নাত। হাদীসে এসেছে-


হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান রা. এর পক্ষ থেকে ১টি বকরী আকীকা দিয়েছেন এবং বলেছেন, হে ফাতেমা ! তার মাথা মুণ্ডন কর এবং চুল পরিমাণ রৌপ্য সদকাহ কর। -[সুনান আত-তিরমিযী: ১৫১৯]

ছেলে সন্তানদের খাতনা করাঃ পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল ছেলে সন্তানদের খাতনা করানোএটি একটি অন্যতম সুন্নাত। এ প্রসংগে হাদীসে এসেছে- 

হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান এবং হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমার সপ্তম দিবসে আকীকা এবং খাতনা করিয়েছেন। -[আল-মুজামুল আওসাত: ৬৭০৮]

তাওহীদ শিক্ষা দেয়া : পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সন্তানদের তাওহীদ শিক্ষা দেয়া শিশু যখন কথা বলা আরম্ভ করবে তখন থেকেই আল্লাহর তাওহীদ শিক্ষা দতে হবে। যেমন-

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে লক্ষ্য করে বলেন : হে বৎস! আমি তোমাকে কয়েকটি বাক্য শিখাতে চাই। তুমি আল্লাহর অধিকারের হেফাযত করবে, আল্লাহও তোমার হেফাযত করবেন। তুমি আল্লাহর অধিকারের হেফাযত করবে, তুমি তাঁকে সর্বদা সামনে পাবে। যখন কোন কিছু চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই চাইবেআর যখন সহযোগিতা চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে। আর জেনে রাখ! যদি পুরো জাতি যদি তোমার কোন উপকার করার জন্য একতাবদ্ধ হয়, তবে তোমার কোন উপকার করতে সমর্থ হবে না, শুধু ততটুকুই করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেনআর যদি পুরো জাতি যদি তোমার কোন ক্ষতি করার জন্য একতাবদ্ধ হয়, তবে তোমার কোন ক্ষতি করতে সমর্থ হবে না, শুধু ততটুকুই করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। কলমের লিখা শেষ হয়েছে এবং কাগজসমূহ শুকিয়ে গেছে।- [তিরমিযী: ২৫১৬] 

কুরআন শিক্ষা দানঃ পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সন্তানদের ছোট বেলা থেকেই সন্তানকে কুরআন শিক্ষা দেয়া। কেননা কুরআন শিক্ষা করা ফরয। কুরআন শিক্ষা দেয়ার চেয়ে উত্তম কাজ আর নেই।

হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের তিনটি বিষয় শিক্ষা দাও। তন্মধ্যে রয়েছে তাদেরকে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা ও কুরআনের জ্ঞান দাও। -[জামিউল কাবীর]

হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়।’’ -[সহীহ বুখারী: ৫০২৭]

সলাত শিক্ষা দেয়া ও সলাত আদায়ে অভ্যস্ত করাঃ পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সন্তানদের ছোট বেলা থেকেই সলাত শিক্ষা দিবেন এবং সলাত আদায়ে অভ্যস্ত করাবেন। যেমন-

আল্লাহ তা’য়ালা বলেন : তোমার পরিবার পরিজনকে নামাজ পড়ার নির্দেশ দাও এবং নিজেও এর উপর অবিচল থাক। -(সূরা ত্ব-হা : ১৩২)

হযরত আমর ইবনে শূয়াইব রাদিয়াল্লাহু আনহু তার বাবা তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের সলাতের নির্দেশ দাও সাত বছর বয়সে। আর দশ বছর বয়সে সলাতের জন্য মৃদু প্রহার কর এবং শোয়ার স্থানে ভিন্নতা আনো। -[সুনান আবূ দাউদ: ৪৯৫]

হযরত আবু হুরাইরাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তোমাদের সন্তানদেরকে ৭ বছর বয়স থেকেই সালাতের শিক্ষা দাও আর যদি তারা ১০ বছর বয়সের পরেও সালাত আদায় না করে তবে প্রয়োজনে তাদেরকে মৃদু প্রহার কর এবং তাদের বিছানা আলাদা করে দাও । -[আবু দাউদঃ হাদিস নং-৪৯৫ ও সহীহ্‌ আল-জামেঃ হাদিস নং-৫৮৬৮]

উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়াঃ
 পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সন্তানদেরকে ছোট বেলা থেকেই উত্তম আমল, আখলাক, আচরণ ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া যেমন-

হযরত লুকমান আলাইহিস সালাম তার সন্তানকে বললেন :  আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। আর যমীনে দম্ভভরে চলাফেরা করো না; নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক, অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না। আর তোমার চলার ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর, তোমার আওয়াজ নীচু কর; নিশ্চয় সবচাইতে নিকৃষ্ট আওয়াজ হল গাধার আওয়াজ।’ - [ সূরা লুকমান ১৮,১৯]

সন্তানদেরকে আদর স্নেহ ও ভালবাসা দেয়াঃ পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সন্তানদেরকে স্নেহ করা এবং তাদেরকে আন্তরিকভাবে ভালবাসা। যেমন-

হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে চুম্বন দিলেন এবং আদর করলেন। সে সময় আকরা ইবনে হাবিস রাদিয়াল্লাহু আনহুও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলতে লাগলেন, আমারতো দশটি সন্তান কিন্তু আমিতো কখনো আমার সন্তানদেরকে আদর স্নেহ করিনি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাকালেন এবং বললেন, যে অন্যের প্রতি রহম করে না আল্লাহও তার প্রতি রহম করেন না। -[সহীহ বুখারী: ৫৯৯৭]

কন্যা সন্তানদের লালন-পালনঃ বর্তমান সমাজে কন্যা সন্তানদের প্রতি পিতা-মাতা কম গুরুত্ব পদান করে থাকেন। পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল- কন্যা সন্তানদেরকে আপদ মনে না করা, তাদেরকে উত্তম মনে করা,  অধিকতর স্নেহ করা এবং তাদেরকে আন্তরিকভাবে ভালবাসা।

হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। নবী সল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: যে ব্যক্তি দুটি মেয়েকে বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করল, সে কিয়ামতের দিন এরূপ অবস্থায় আসবে যে, আমি ও সে এরূপ একত্রিত থাকব। তিনি তাঁর আংগুলগুলো মিলিয়ে দেখালেন। -(মুসলিম)

দ্বীনি ইলম শিক্ষা দেয়াঃ পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সন্তানদেরকে দীনি ইলম শিক্ষা দেয়া দীনি ইলম শিক্ষা দেয়া ফরজকারণ দ্বীনি ইলম না থাকলে সে বিভ্রান্ত এবং ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত হবে।

হযরত আনাস বিন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক মুসলিমের উপর জ্ঞানার্জন করা ফরয। -[সুনান ইবন মাজাহ: ২২৪]

প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন ও ভরণ-পোষণ করাঃ পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সন্তানদেরকে প্রাপ্ত বয়স্ক পর্যন্ত লালন-পালন করা এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ করা 

হযরত উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম আবূ সালামার সন্তানদের জন্য আমি যদি খরচ করি এতে কি আমার জন্য প্রতিদান রয়েছে? নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ যতদিন তুমি খরচ করবে ততদিন তোমার জন্য প্রতিদান থাকবে। -[সহীহ বুখারী: ৫৩৬৯]

সন্তানদেরকে উপার্জনক্ষম করে তোলাঃ পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সন্তানদেরকে এমনভাবে সক্ষম করে গড়ে তোলা, তারা যেন উপার্জন করার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।

হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে এভাবে বলেছেন, তোমাদের সন্তান সন্ততিদেরকে সক্ষম ও সাবলম্বি রেখে যাওয়া, তাদেরকে অভাবী ও মানুষের কাছে হাত পাতা অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে উত্তম। -[সহীহ বুখারী:১২৯৫]

সন্তানদেরকে বিবাহ দেয়াঃ পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সন্তানদেরকে সুন্নাহ পদ্ধতিতে বিবাহ দেয়া এবং বিবাহর যাবতীয় কাজ সম্পাদন করা এবং উপযুক্ত সময়ে বিবাহর ব্যবস্থা করা।

আল্লাহ তা’য়ালা বলেন : "তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত , তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ”-(সূরা নুরঃ ৩২)

হযরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, নিশ্চয়ই পিতার উপর সন্তানের হকের মধ্যে রয়েছে, সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাকে বিবাহ দেবে। -[জামিউল কাবীর]

দ্বীনের পথে পরিচালিত করাঃ পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সন্তানদেরকে দ্বীনের পথে, কুরআন-সুন্নাহর পথে পরিচালনা করা, দ্বীনের বিধান পালনের ক্ষেত্রে অভ্যস্ত করে তোলা। যেমন-

আল্লাহ তায়ালা বলেন : “বলুন! ‘এটা আমার পথ। আমি জেনে-বুঝে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেই এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও। আর আল্লাহ পবিত্র মহান এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত নই  -[সূরা ইউসুফ : ১০৮] 

সন্তানদের মাঝে ইনসাফ করাঃ পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সন্তানদের মাঝে ইনসাফ করা। সন্তানগণ পিতামাতার কাছ থেকে ইনসাফ আশা করে এবং তাদের মাঝে ইনসাফ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মিরাসের আয়াত থেকে কেহ কেহ মনে করেন যে, ছেলেদেরকে মেয়েদের তুলনায় দিগুণ দিতে হবে-এটা একটি মারাত্মক ভুল!  ইসলামের দাবী হল- জীবিত থাকা কালীন ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সকল সন্তানদের মধ্যে সমতা বজায় রাখতে হবে। অবশ্য মৃত্যুর পর পরিত্যাক্ত সম্পদে মিরাস কার্যকরী হবে। অর্থাৎ পরিত্যাক্ত সম্পদ থেকে মৃত্যের ঋন ও অসিয়াত আদায়ের পর বাকী সম্পদে মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা দ্বিগুণ সম্পদের হকদার হবে।

রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক করে বলেছেন : তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমাদের সন্তাদের মাঝে ইনসাফ করো। -[সহীহ বুখারী: ২৫৮৭]

হযরত নোমান ইবনে বাশীর রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে তার পিতা তাকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট নিয়ে আসলেন। তারপর বললেন, আমি আমার এই ছেলেকে একটি গোলাম দান করেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার সকল সন্তানকে কি এভাবে একটি করে গোলাম দান করেছ?” তিনি বললেন, না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাহলে তার নিকট থেকে এটা ফিরিয়ে নাও। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমার সন্তানদের মাঝে ইনসাফ কর” -(সহীহ বুখারী, ফাতহুল বারীঃ ৫/২২১) হযরত নোমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তিনি ফিরে এসে সেই দানটি ফিরিয়ে নিলেন। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “...অত:এব এ ব্যাপারে আমাকে সাক্ষী রাখিও না। কারণ, আমি জুলুমের সাক্ষী হতে পারি না।” (সহীহ মুসলিমঃ  ১২৪৩)

ইসলাম পরিপন্থি কাজ থেকে বিরত রাখাঃ  পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সন্তানদেরকে ইসলাম পরিপন্থি এবং ইসলাম অনুমোদন করে না এমন সব কাজ, কথা, অভ্যাস, আচরণ ও কালচার থেকে বিরত রাখা। অন্যথায় সন্তানগনই কিয়ামাতে পিতামাতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। যেমন- 

আল্লাহ তায়ালা বলেন :  হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিজনদেরকে সে আগুন থেকে রক্ষা কর, যে আগুনের জ্বালানী হবে মানুষ এবং পাথর, যে আগুনের পাহারাদার হবে নির্মম হৃদয় ও কঠোর স্বভাবের অধিকারী ফেরেশতাগণ। তারা আল্লাহর কোন আদেশের অবাধ্য হন না। বরং তিনি তাদেরকে  যে কাজ করার আদেশ করেন, তারা তাই করেন। -(সূরা তাহরীম : ৬)

তিনি আরও বলেন : আর কাফিররা বলবে, হে আমাদের রব, জ্বিন ও মানুষের মধ্যে যারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে তাদেরকে আমাদের দেখিয়ে দিন। আমরা তাদের উভয়কে আমাদের পায়ের নীচে রাখব, যাতে তারা নিকৃষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়।  -[সূরা হা-মীম আসসিজদাহ-২৯ ]

পাপকাজ, অশ্লিলতা, বেহায়াপনা, অপসংস্কৃতি থেকে বিরত রাখাঃ পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সন্তানদেরকে পাপকাজ, অশ্লিলতা, বেহায়াপনা, অপসংস্কৃতি থেকে বিরত রাখা সন্তান দুনিয়ার আসার সাথে সাথে শয়তান তার পেছনে লেগে যায় এবং বিভিন্নভাবে, ভিন্ন ভিন্ন রুপে,পোশাক-পরিচ্ছেদের মাধ্যমে, বিভিন্ন ফ্যাশনে, বিভিন্ন ডিজাইনে, বিভিন্ন শিক্ষার নামে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র করে। তাই পিতা-মাতাকে অবশ্যই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। যেমন- 

আল্লাহ তায়ালা বলেন :  হে মুমিনগণ, তোমাদের স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের কেউ কেউ তোমাদের দুশমন। অতএব তোমরা তাদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। আর যদি তোমরা মার্জনা কর, এড়িয়ে যাও এবং মাফ করে দাও তবে নিশ্চয় আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু। -[সূরা তাগাবুন-১৪] 

হযরত ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলে করীম রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষের বেশ ধারণকারী নারী ও নারীর বেশ ধারণকারী পুরুষকে অভিসম্পাত করেছেন। [সহীহ বুখারী:৫৮৮৫]

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাথে সা-দৃশ্যতা রাখবে সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে। [সুনান আবূ দাউদ:৪০৩১]

পরিবারের সদস্যদের জন্য দোয়াঃ পিতা-মাতার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সন্তানদের হিদায়াত ও কল্যাণের জন্য নবী-রসূলগণের ন্যায় আল্লাহর কাছে সর্বদা দোয়া করা। যেমন-

নেককার সন্তান-সন্ততি লাভের দোয়া : নেককার সন্তান-সন্ততি, বংশধর লাভের জন্য হযরত জাকারিয়া আলাইহিস্সালাম এর যেমন দোয়া করেছিলেন-

رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَّاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِيْنَ إِمَامًا

অর্থাৎ- হে আমাদের রব! আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে ও সন্তানদের পক্ষ থেকে চোখের শীতলতা দান করুন এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের ইমাম করুন। (সূরা ফুরকান : ৭৪)

رَبِّ اجْعَلْنِيْ مُقِيْمَ الصَّلَاةِ وَمِنْ ذُرِّيَّتِيْ رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُّعَاءِ

অর্থাৎ- হে আমার প্রতিপালক! আমাকে সালাত কায়িমকারী করুন এবং আমার বংশধরকেও সালাত কায়িমকারী করুন। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের প্রার্থনা কবুল করুন। (সূরা ইব্রাহীম : ৪০)

رَبِّ هَب لِي مِن لَّدُنكَ ذُرِّيَّة طَيِّبَةًۖ إِنَّكَ سَمِيعُ ٱلدُّعَآءِ

অর্থাৎ-হে আমার রব, আমাকে আপনার পক্ষ থেকে উত্তম সন্তান দান করুন। নিশ্চয় আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী [সূরা আলে ইমরান : ৩৮]

উত্তম সন্তানের উপকারীতাঃ হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে ৩ টি আমল বন্ধ হয় না- ১. সদকায়ে জারিয়া  ২. এমন জ্ঞান-যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় ৩. এমন নেক সন্তান- যে তার জন্য দোআ করে- [সহিহ মুসলিম:১৬৩১]

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সন্তানদেরকে নেককার সন্তান হিসাবে কবুল করুন এবং সন্তানদের হক সমুহ যথাযথ ভাবে আদায় করার তৌফিক দান করুন।


No comments:

Post a Comment