আন্তঃজাতীয়
জীবনে ইসলামের উত্তম আচরণ
ডাঃ গাজী মোঃ
নজরুল ইসলাম
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা'য়ালার জন্য যিনি রব্বুল আলামীন। দুরুদ
ও সালাম রসূলুল্লাহ্ সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি যিনি রহমাতুল্লিল
আলামীন, তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কিরাম
(রাদিয়াল্লাহু আনহুম) এবং সালেহীন (র)-গণের প্রতি। আমরা
সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই। আমরা
আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)
তাঁর বান্দাহ ও রসূল। নিশ্চয়ই শুভ পরিনাম কেবলমাত্র মুত্তাকীন
বান্দাগণের জন্যই নির্ধারিত।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে মুসলিম
উম্মাহর সাথে বৈষয়িক সম্পর্ক ইনসাফ ও সদাচারের ভিত্তিতে পরিচালিত। মুসলিম উম্মাহর আভ্যান্তরীন সম্পর্কের ভিত্তি হল ঈমান।
ঈমানের ভিত্তিতেই তাদের বন্ধুত্ব ও সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ব কায়েম হবে। যাদের ঈমান নেই, এমন সব জাতির সাথে মুসলিম উম্মাহর কোন বন্ধুত্ব হতে পারে না। তবে
একই আদি পিতার বংশধর হিসাবে তাদের সাথে ইনসাফের ভিত্তিতে সু সম্পর্ক বজায় রাখতে
হবে এবং সদাচারের সর্বোত্তম প্রকাশের মাধ্যমে ঈমানের সৌন্দর্য্য তুলে ধরতে হবে।
এ প্রসংগে মহান আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন বলেন : “হে মুমিনগণ! তোমরা আমার শত্রু ও তোমাদের শত্রু-কে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ কর না। তোমরা তাদের নিকট বন্ধুত্বের প্রস্তাব
পাঠিয়েছো আর তারা তোমাদের নিকট যে সত্য এসেছে তা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং তোমাদের
প্রতিপালক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার কারণে রাসূলকে ও তোমাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কার
করেছে। যদি তোমরা আমার পথে জিহাদ করার জন্য এবং আমার সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে বের
হয়ে থাক, তাহলে তাদের সাথে কেন গোপনে বন্ধুত্ব করতে চাচ্ছ?
তোমরা যা গোপন কর এবং তোমরা যা প্রকাশ কর আমিই তা সবচেয়ে বেশি জানি।
তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এমন করবে সে সঠিক-সরল পথ থেকে
বিচ্যুত হবে। যদি তারা তোমাদেরকে বশীভূত করতে পারে, তাহলে
তারা তোমাদের শত্রুই হয়ে যাবে। তারা তাদের হাত ও মুখ দিয়ে তোমাদের ক্ষতি করবে এবং
কামনা করবে যে, তোমরাও কাফির হয়ে যাও। অথচ তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, সন্তান-সন্ততি
কিয়ামাতের দিন তোমাদের কোন কাজেই আসবে না। আল্লাহ তোমদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন।
তোমরা যা কর, আল্লাহ তা দেখেন। ইব্রাহীম ও তার অনুসারীদের মধ্যে
তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে। যখন তারা তাদের জাতিকে বলেছিলেন: ‘তোমাদের সাথে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমরা যার উপাসনা কর
তাদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদের সম্পর্ক অস্বীকার করি। যতক্ষণ না
তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আন ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের ও আমাদের মধ্যে চিরকালের
শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়ে গেল।’ তবে তার পিতার প্রতি
ইব্রাহীমের কথা এ থেকে ভিন্ন ছিল। তিনি বলেছিলেন : ‘আমি
অবশ্যই আপনার জন্য ক্ষমা চাইব, তবে আল্লাহর নিকট আপনার
ব্যাপারে আমি কোন কিছু করার ক্ষমতা রাখি না।’ ইব্রাহীম ও
তাঁর অনুসারীগণ বলেছিলেন: ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনার
উপরই নির্ভর করেছি, আপনার প্রতি অগ্রসর হয়েছি এবং ফিরে আসব
আপনার কাছেই। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদেরকে কাফিরদের জন্য পরীক্ষা পাত্র
বানাবেন না। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আপনি তো
মহাপরাক্রমশালী, মহাপ্রজ্ঞাময়’। তোমরা যারা আল্লাহর সান্নিধ্য ও
আখিরাতে সফলতা প্রত্যাশা কর নিশ্চয় তাদের জন্য ইব্রাহীম ও তার অনুসারীদের মধ্যে
উত্তম আদর্শ রয়েছে। আর কেউ তাদের আদর্শ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে সে জেনে রাখুক, নিশ্চয় আল্লাহ মহাধনী (অমুখাপেক্ষী), মহাপ্রশংসিত। যাদের সাথে তোমাদের শত্রুতা রয়েছে আল্লাহ হয়ত তাদের ও
তোমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে দেবেন। আল্লাহ সর্বশক্তিমান, আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, অসীম করুণাময়। দ্বীন-এর ব্যাপারে যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে নি এবং তোমাদেরকে দেশ থেকে বেরও
করে দেয় নি তাদের সাথে সদাচার ও সুবিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেননি।
নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালবাসেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে
নিষেধ করেন যারা দ্বীন-এর ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে,
তোমাদেরকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে এবং তোমাদেরকে বের করে দেয়ার
ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে। যারা তাদের সাথে বন্ধু করে তারাই সীমালংঘনকারী।” -(সূরা মুমতাহিনাঃ আয়াত ১-৯)
অমুসলিমদের
সাথে উত্তম ভাষনঃ মহান আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন বলেন : “আপনি মানুষকে আপনার প্রতিপালকের পথে
আহ্বান করুন প্রজ্ঞা ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে কথা বলুন সবচেয়ে
সুন্দরভাবে। নিশ্চয়ই আপনার রব ভাল জানেন কে তার পথ ছেড়ে বিপথগামী হয় এবং তিনি
তাদের সম্পর্কেও ভাল জানেন যারা সঠিক পথে পরিচালিত।” -(সূরা নহল : আয়াত১২৫)
অমুসলিমদের
সাথে উত্তম আচরণঃ “তারচেয়ে উত্তম কথা আর কার যে ব্যক্তি
মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, সৎকাজ করে এবং বলে নিশ্চয়ই আমি
একজন মুসলিম। ভাল ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দকে ভাল দিয়ে প্রতিহত কর। তাহলে যে
তোমার শত্রু সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যাবে। এ জাতীয় চরিত্রের অধিকারী কেবল সে
সকল লোকদেরকে করা হয় যারা ধৈর্যশীল। এ গুণের অধিকারী কেবল তারা যারা মহাসৌভাগ্যের
অধিকারী।” -(সূরা হা-মীম সিজদা : আয়াত ৩৩-৩৫)
অমুসলিমদের
আচরণে দুঃখিত না হওয়াঃ মহান আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন বলেন : “ (হে রাসূল!) আল্লাহর এই উদাত্ত
আহ্বান ও আপনার দাওয়াতের পরও তারা (কাফির-মুশরিকরা) যদি তা
গ্রহণ না করে বরং মুখ ফিরিয়ে চলে যায় তাহলে আপনার দুঃখিত হওয়ার কোন কারণ নেই।
কেননা আমি তো আপনাকে তাদের রক্ষক করে প্রেরণ করিনি। আপনার কাজ হল কেবল তাদের নিকট
আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেয়া। আমি মানুষকে যখন নি’আমত দান করি,
তখন সে আনন্দিত হয় আর যখন তাদের মন্দ কাজের পরিণাম হিসেবে তাদের
বিভিন্ন বিপদ-আপদ ঘটে তখন তারা অকৃতজ্ঞ হয়ে যায়।” -(সূরা শুরা : ৪৮)
জোর করে কাউকে দ্বীন
গ্রহণে বাধ্য না করাঃ মহান আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন বলেন : “ দ্বীনের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি
নেই। মিথ্যা পথ হতে সত্য পথ আলাদা হয়ে গেছে। কাজেই যে আল্লাহ বিরোধী শক্তিকে
অস্বীকার করেছে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে সে এমন এক মজবুত হাতল ধারণ করেছে যা
কখনো ভাঙবে না। আর আল্লাহ সব কিছু শোনেন, সবকিছু জানেন।” -(সূরা বাকারাহ : ২৫৬)
অমুসলিম
উপাস্যদেরকে গালি দেয়া যাবে নাঃ মহান আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন বলেন : “ তারা আল্লাহ তা‘আলার বদলে যাদের ডাকে, তাদের তোমরা কখনো গালি দিয়ো
না, নইলে তারাও শত্রুতার কারণে না জেনে আল্লাহ তা‘আলাকেও গালি দেবে, আমি প্রত্যেক জাতির কাছেই তাদের
কার্যকলাপ সুশোভনীয় করে রেখেছি, অতঃপর সবাইকে একদিন তার মালিকের
কাছে ফিরে যেতে হবে, তারপর তিনি তাদের বলে দেবেন, তারা দুনিয়ার জীবনে কে কী কাজ করে এসেছে’’। {সূরা আল আন‘আমঃ ১০৮}
তাওহীদ ভিত্তিক
ঐক্যের আহ্বানঃ মহান আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন বলেন : “ (হে রাসূল!) আপনি বলুন, হে আহলি কিতাব! এস আমরা এমন একটি কথায় ঐক্যবদ্ধ হই, যে
কথাটি তোমাদের এবং আমাদের মধ্যে অভিন্ন। সে কথাটি হল- আমরা যেন আল্লাহ ছাড়া আর
কারো ইবাদাত না করি, তাঁর সাথে যেন কাউকে শরীক না করি এবং
আমাদের কেউ যেন তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে প্রতিপালক হিসেবে গ্রহণ না করি। এ কথার
পরও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে বলুন : তোমরা সাক্ষী
থাকো যে, আমরা অবশ্যই মুসলিম (আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণকারী)।” -(সূরা আলে ইমরান : ৬৪)
চুক্তি
খেয়ানতকারী মুশরিকদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট ঘোষনার মাধ্যমে চুক্তি বাতিল করতে হবে, এরপরও তাদেরকে সংশোধনের সময় দিতে হবেঃ
“সম্পর্কচ্ছেদ করা হলো আল্লাহ ও তাঁর রসূলের
পক্ষ থেকে সেই মুশরিকদের সাথে, যাদের সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলে।
অতঃপর তোমরা পরিভ্রমণ কর এদেশে চার মাসকাল। আর জেনে রেখো, তোমরা
আল্লাহকে পরাভূত করতে পারবে না, আর নিশ্চয়ই আল্লাহ
কাফেরদিগকে লাঞ্ছিত করে থাকেন।” -(সূরা তাওবা : আয়াত ১-২)
বশ্যতা
স্বীকার ও জিযিয়া প্রদানে সম্মত হলে অমুসলিম জাতির বিরুদ্ধে আর যুদ্ধ করা যাবে নাঃ মহান
আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন বলেন : “তোমরা
যুদ্ধ করতে থাক আহলে কিতাবের ঐ লোকদের বিরুদ্ধে, যারা ঈমান
আনে না আল্লাহর প্রতি এবং শেষ দিনের প্রতি, আল্লাহ ও তাঁর
রাসূল যা হারাম করেছেন তা হারাম মনে করে না, এবং অনুসরণ করে
না প্রকৃত সত্য দ্বীন, যে পর্যন্ত না তারা বশ্যতা স্বীকার
করে, স্বহস্তে জিযিয়া প্রদান করে।” - [সূরা তাওবা : আয়াত ২৯]
জিযিয়ার
পরিমানঃ আবদুল্লাহ ইবন মুহাম্মদ নুফায়লী (র.)
সুত্রে হযরত মু’আয রাদিআল্লাহু
আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম যখন হযরত মু’আয রাদিআল্লাহু আনহু -কে
ইয়ামনে প্রেরণ করেন, তখন তাঁকে এরূপ নির্দেশ দেন যে, প্রত্যেক অমুসলিম প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির নিকট হতে (বার্ষিক) এক দীনার অথবা
এক দীনার মূল্যের মু’আফিরী নামক কাপড়, যা
ইয়ামনে উৎপন্ন হয় জিযিয়া হিসাবে গ্রহণ করবে।” -[মুয়াত্তা –ইমাম মালিক ও বুলুগূল মারামঃ ১৩২২]
ইমাম মালিক
(রঃ) বলেন : প্রচলিত সুন্নত হল, অমুসলিম ও আহলে কিতাব নারী ও শিশুদের ওপর জিয্য়া ধার্য
হবে না। যুবকদের নিকট হতেই কেবল জিযিয়া আদায় করা হবে। কারণ স্বীয়
অঞ্চলে বসবাস করা এবং শত্রু হতে রক্ষা করার ভিত্তিতেই তাদের উপর জিয্য়া
ধার্য করা হয়েছিল। অমুসলিমদের পশুপাল, ফল এবং কৃষিক্ষেত্রে কোনরূপ যাকাত ধার্য করা যাবে না।
এমনিভাবে অমুসলিমদেরকে তাদের পৈতৃক ধর্মে প্রতিষ্ঠিত থাকতে দেয়া হবে এবং তাদের ধর্মীয়
বিষয়ে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করা যাবে না।
শত্রুরা
সন্ধি করতে চাইলে যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে হবে এবং সম্মানজনক সন্ধি করতে হবেঃ মহান আল্লাহ্
রাব্বুল ‘আলামীন বলেন : “কাফিররা যদি সন্ধি করতে আগ্রহী হয়, তাহলে আপনিও
সন্ধি করতে আগ্রহী হবেন এবং আল্লাহর প্রতি নির্ভর করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু
শোনেন, সবকিছু
জানেন। যদি তারা (সন্ধির প্রতি আগ্রহ দেখিয়ে) আপনাকে প্রতারণা করতে চায় তাহলে
আপনার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি আপনাকে নিজের সাহায্য এবং মুমিনদের মাধ্যমে
শক্তিশালী করেছেন, তিনি
মুমিনদের হৃদয়ে পরস্পরের জন্য ভালবাসা তৈরি করে দিয়েছেন। পৃথিবীর সমস্ত অর্থ-সম্পদ ব্যয়
করলেও আপনি তাদের মনে এমন ভালবাসা তৈরি করতে পারতেন না। কিন্তু আল্লাহ তাদের মধ্যে
ভালবাসা তৈরি করে দিয়েছেন। নিশ্চয় আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, মহাবিজ্ঞানী।
হে নবী! আপনার জন্য এবং আপনার অনুসারী মুমিনদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট”। -(সূরা আনফালঃ আয়াত ৬১-৬৪)
চুক্তির মর্যাদা রক্ষা করতে হবেঃ মহান আল্লাহ্
রাব্বুল ‘আলামীন বলেন : “যারা ঈমান এনেছে, হিজরাত করেছে, জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে আর যারা
আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে তারা একজন আরেকজনের বন্ধু। যারা ঈমান এনেছে কিন্তু হিজরাত
করে নি, হিজরাত
না করা পর্যন্ত তাদের ব্যাপারে তোমাদের কোন দায়িত্ব নেই। তবে দীন সম্পর্কে যদি
তারা তোমাদের সাহায্য চায় তাহলে তাদেরকে সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য। তবে যে
জাতির সাথে তোমাদের চুক্তি রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সাহায্য করা কর্তব্য নয়। তোমরা যা
কর আল্লাহ তা‘আলা তা
সবই দেখেন”।-(সূরা আনফালঃ আয়াত ৬৯)
যুদ্ধরত
অবস্থায়ও প্রতিপক্ষের সাধারণ জনগন, ঘর-বাড়ি ও গাছপালা রক্ষনীয়ঃ মুতার
যুদ্ধে রওনা হওয়ার প্রাক্কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বাহিনীকে
নির্দেশ দেন, ‘তোমরা
কোনো নারীকে হত্যা করবে না,
অসহায় কোনো শিশুকেও না;
আর না অক্ষম বৃদ্ধকে। আর কোনো গাছ উপড়াবে না, কোনো খেজুর গাছ জ্বালিয়ে দেবে না। আর
কোনো গৃহও ধ্বংস করবে না।’
- (মুসলিমঃ ১৭৩১)
যুদ্ধাবস্থায়ও অমুসলিমদের উপাসনালয় রক্ষণীয়ঃ হযরত হাবীব ইবন অলীদ রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম সৈন্যদল প্রেরণকালে বলতেন : ‘তোমরা
আল্লাহ ও আল্লাহর নামে আল্লাহর পথে যাত্রা কর। তোমরা আল্লাহর প্রতি কুফরকারীদের
বিরুদ্ধে লড়াই করবে। আমি তোমাদের কয়েকটি উপদেশ দিয়ে প্রেরণ করছি :
(যুদ্ধক্ষেত্রে) তোমরা বাড়াবাড়ি করবে না, ভীরুতা দেখাবে না,
(শত্রুপক্ষের) কারো চেহারা বিকৃতি ঘটাবে না, কোনো
শিশুকে হত্যা করবে না, কোনো গির্জা জ্বালিয়ে দেবে না এবং
কোনো বৃক্ষও উৎপাটন করবে না।’ [আবদুর রাযযাক, মুসান্নাফ : ৯৪৩০]
যুদ্ধাবস্থায়ও অমুসলিমদের কোন উপাসনালয়ের অধিবাসীদেরকে হত্যা করা যাবে নাঃ হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের কোনো বাহিনী প্রেরণ করলে বলতেন, ‘তোমরা
গির্জার অধিবাসীদের হত্যা করবে না।’ [ইবন আবী শাইবা, মুসান্নাফ : ৩৩৮০৪; কিতাবুল জিহাদ, যুদ্ধক্ষেত্রে যাদের হত্যা করা নিষেধ অধ্যায়]
ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু
বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ও একই পথে হাঁটেন। তার খিলাফতকালের প্রথম যুদ্ধের বাহিনী
প্রেরণকালে তিনি এর সেনাপতি উসামা ইবন জায়েদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর উদ্দেশে বলেন, ‘হে লোক সব, দাঁড়াও আমি
তোমাদের দশটি বিষয়ে উপদেশ দেব। আমার পক্ষ হিসেবে কথাগুলো তোমরা মনে রাখবে। কোনো
খেয়ানত করবে না, বাড়াবাড়ি
করবে না, বিশ্বাসঘাতকতা
করবে না, (শত্রুদের
লাশ) বিকৃত করবে না, ছোট
বাচ্চাকে হত্যা করবে না,
বয়োবৃদ্ধকেও না এবং নারীকেও না। খেজুর গাছ কাটবে না কিংবা তা জ্বালিয়েও দেবে
না। কোনো ফলবতি গাছ কাটবে না। আহারের প্রয়োজন ছাড়া কোনো ছাগল, গরু বা উট জবাই
করবে না। আর তোমরা এমন কিছু লোকের সামনে দিয়ে অতিক্রম করবে যারা গির্জাগুলোয়
নিজেদের ছেড়ে দিয়েছে। তোমরাও তাদেরকে তাদের মতো করে এবং তারা যা ছেড়ে দিয়েছে
নিজেদের জন্য, তার
ওপর ছেড়ে দেবে। - (মুখতাসারু তারিখি দিমাশক : ১/৫২; তারিখুত তাবারি)
আশ্রয়প্রার্থী
অমুসলিমদের আশ্রয় প্রদানঃ মহান আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ “যদি কোনো মুশরিক তোমার আশ্রয় চায় তাহলে তাকে আশ্রয় দাও, যেন সে আল্লাহর কালাম শুনতে পায়। অতঃপর তাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দাও।
এটা এ জন্য যে, তারা এমন জাতি, যারা
অজ্ঞ।” -(সূরা তাওবাহ : ৬)
একজন
মুসলিম কোন অমুসলিমকে নিরাপত্তা দিলে তা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেই নিরাপত্তা হিসাবে
গণ্য হবেঃ উম্মে হানী রাযিয়াল্লাহু অনহা থেকে বর্ণিত। তিনি
বলেন, আমি মক্কা বিজয়ের বছর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট
যাই। তিনি তখন গোসল করছিলেন এবং তাঁর মেয়ে ফাতেমা তাঁকে পর্দা দ্বারা ঘিরে
রেখেছিলেন। উম্মে হানী বলেন, আমি তাঁকে সালাম দিলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন : ‘কে?’ আমি বললাম : আমি উম্মে হানী বিন্তে আবু তালিব। তিনি [সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম] বললেন : উম্মে হানীকে স্বাগতম! অতঃপর তিনি গোসল সেরে একটি কাপড় পরে
৮ রাকাত সালাত আদায় করলেন। তিনি সালাত শেষ করলে আমি বললাম: হে আল্লাহর রসূল! আমার
বৈমাত্রিয় ভাই ধারণা করছে যে সে একজন মানুষকে হত্যা করেছে আর আমি হুবাইরার বেটা
উমুককে নিরাপত্তা দান করেছি। তিনি [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] বললেন : হে
উম্মে হানী! আপনি যাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন আমিও তাকে নিরাপত্তা দান করলাম। উম্মে
হানী বলেন : সে সময়টা ছিল চাশতের। (বুখারীঃ ৩৫৭ ও মুসলিমঃ ৩৩৬)
একজন মুসলিম
কর্তৃক নিরাপত্তা প্রাপ্ত কোনো অমুসলিমকে কেউ হত্যা করতে পারবে নাঃ হযরত আবদুল্লাহ
ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘যে মুসলিম কর্তৃক
নিরাপত্তা প্রাপ্ত কোনো অমুসলিমকে হত্যা করবে, সে জান্নাতের
ঘ্রাণও পাবে না। অথচ তার ঘ্রাণ পাওয়া যায় চল্লিশ বছরের পথের দূরত্ব থেকে’। -[ সহীহ
বুখারী : ৩১৬৬]
চুক্তিবদ্ধ কোন
অমুসলিমকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা যাবে নাঃ হযরত আবী
বাকরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি চুক্তিতে
থাকা কোনো অমুসলিমকে অসময়ে (অন্যায়ভাবে) হত্যা করবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত
হারাম করে দেবেন’। -[আবূ দাঊদ : ২৭৬০; নাসাঈ : ৪৭৪৭,
শাইখ আলবানীও হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।]
বিচারের দিনে
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং মাজলুম অমুসলিমদের পক্ষে
দাঁড়াবেনঃ কোনো মুসলিম যদি কোনো অমুসলিমের প্রতি অন্যায় করেন, তবে রোজ কিয়ামতে খোদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বিপক্ষে
লড়বেন বলে হাদীসে এসেছে। একাধিক সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘সাবধান! যদি কোনো মুসলিম কোনো অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে তার
অধিকার খর্ব করে, তার ক্ষমতার বাইরে কষ্ট দেয় এবং তার কোনো
বস্তু জোরপূর্বক নিয়ে যায়, তাহলে কিয়ামতের দিন আমি তার
পক্ষে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ উত্থাপন করব।’ -[আবূ
দাঊদ : হাদীস নং ৩০৫২]
অমুসলিমদের
কালচারও সংরক্ষিত থাকবে- মুসলিমগণ অনুকরণ করতে পারবে নাঃ হযরত
আবু উমামা বাহেলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া-সাল্লাম বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের কৃষ্টি-কালচারের
অনুকরণ করবে, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত গণ্য হবে এবং যে ব্যক্তি
যে সম্প্রদায়কে মহব্বত করবে, তাদের সাথে তার হাশর হবে।”
-(আবু দাউদঃ হাদীস নং ৩৫১৪)
একই বিষয়েঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে
উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে সামঞ্জস্য বা মিল রাখে, সে তাদেরই দলভুক্ত এবং তার হাশর-নশর
তাদের সাথেই হবে।” -(মুসনাদে আহমদ(
অমুসলিমদের
সাথে আচরণে নম্রতা অবলম্বনঃ হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে
বর্ণিত। একবার একদল ইয়াহূদী নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম-এর
নিকট এসে বললঃ আস্-সামু 'আলাইকুম! (তোমার মরণ হোক) । 'আয়িশাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বললেনঃ তোমাদের উপরই এবং তোমাদের উপর আল্লাহর
লা'নত ও গযব পড়ুক। তখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম
বললেনঃ হে 'আয়িশাহ! একটু থামো । নম্রতা অবলম্বন করা তোমাদের
কর্তব্য। রূঢ়তা ও অশালীনতা বর্জন করো। 'আয়িশাহ (রাদিয়াল্লাহু
আনহা) বললেনঃ তারা যা বলেছে তা কি আপনি শোনেননি ? তিনি
বললেনঃ আমি যা বললাম, তুমি কি তা শোননি? কথাটি তাদের উপরই ফিরিয়ে দিয়েছি। সুতরাং তাদের ব্যাপারে (আল্লাহর কাছে)
আমার কথাই কবুল হবে আর আমার সম্পর্কে তাদের কথা কবুল হবে না। -[সহিহ বুখারীঃ হাদীস
নং ৬০৩০]
বিবাদরতদের
মাঝে সমঝোতা ও শান্তি স্থাপনঃ হযরত আবু দারদা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে
বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ
করেছেন- ‘আমি কি তোমাদেরকে সিয়াম, সালাত ও সদকার
মর্তবা থেকেও শ্রেষ্ঠ বিষয় সম্পর্কে বলব না?’ সবাই আরজ
করলেন, ‘আল্লাহর রাসূল! অবশ্যই বলুন।’ তিনি
বললেন, ‘বিবাদরতদের মাঝে শান্তি স্থাপন করা। আর জেনে রেখো,
পরস্পর কলহ-বিবাদই তো মানুষকে মুড়িয়ে দেয়।’ –(মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৭৫০৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪৯১৯; জামে তিরমিযী, হাদীস
: ২৫০৯)
অমুসলিমদের
সাথে উত্তম মানবিক ব্যবহারঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আবদস ওহহাব (রহঃ)
সুত্রে হযরত আনাস ইবন মালিক (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। একদা এক বেদুঈন
মসজিদে পেশাব করলো। লোকেরা উঠে (তাকে মারার জন্য) তার দিকে গেল। রাসুলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তার পেশাব করা বন্ধ করো না। তারপর তিনি
এক বালতি পানি আনালেন এবং পানি পেশাবের উপর ঢেলে দেয়া হলো। -[সহীহ বুখারি অধ্যায়ঃ আচার ব্যবহার হাদিস নাম্বারঃ ৫৬০০]
জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের প্রতি দয়া প্রদর্শনঃ হযরত
জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেছেনঃ যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া
প্রদর্শন করে না আল্লাহও তার প্রতি রহম করেন না। -{তিরমিযিঃ ১৯২৮,
সহীহ বুখারীঃ ৭৩৭৬, মুসনাদ আহমাদঃ ১৮৭৭৫, সহীহ মুসলিমঃ ৪২৯০, সহীহ ইবনে হিব্বানঃ ৪৬৫,শরহুস সুন্নাহঃ ৩৪৪৯}
অন্যায়ভাবে
কারও কোন প্রকার ক্ষতি সাধন না করাঃ হযরত উবাদাহ বিন সামিত
রাদিয়াল্লাহু আনহু ও আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তাঁরা
বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “তুমি কারোর কোনো ধরনের
ক্ষতি করো না। তেমনিভাবে তোমরা পরস্পর একে অপরের ক্ষতি করার প্রতিযোগিতা করো না’’ -[ইবন মাযাহঃ ২৩৬৯, ২৩৭০]
হযরত আবু সিরমাহ রাদিয়াল্লাহু
আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “যে ব্যাক্তি অন্যের ক্ষতি করতে চায়,
আল্লাহ্ তায়ালা তার ক্ষতি করেন। তেমনি ভাবে যে ব্যাক্তি অন্যের উপর
কঠিন হয় আল্লাহ্ তায়ালাও তার উপর কঠিন হন’’ -[ইবন মাযাহ ২৩৭১]
অমুসলিমদের সাথে সদাচারঃ হযরত ইবনে আব্বাস
(রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্
সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মুয়ায (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে ইয়েমেনে
পাঠানোর সময় বলেন : মাজলুমের বদ-দোয়াকে ভয় কর, কেননা তার বদ-দোয়া ও আল্লাহর
মাঝখানে কোন বাধা নেই। -(তিরমিযী-১৯৬৩ : হাসান ও সহীহ্)
আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সবাইকে তাঁর দ্বীনের খেদমতের জন্য কবুল করুন! রসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবা (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-গনের আদর্শের উপর
সর্বদা কায়েম রাখুন! তাঁদের বরকতময় জামাআতের সংগে আমাদের হাশর করুন! আ-মী-ন।

No comments:
Post a Comment