Monday, November 10, 2014

মুহাররম মাস ও আশুরার ফজিলত


মুহাররম মাস ও আশুরার ফজিলত
ডাঃ গাজী মোঃ নজরুল ইসলাম
 
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা'য়ালার জন্য যিনি রব্বুল আলামীনদুরুদ ও সালাম রসূলুল্লাহ্ সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি যিনি রহমাতুল্লিল আলামীন, তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কিরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) এবং সালেহীন (র)-গণের প্রতিআমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাইআমরা আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর বান্দাহ ও রসূলনিশ্চয়ই শুভ পরিণতি শুধুমাত্র মুত্তাকীন বান্দাগণের জন্যই নির্ধারিত।

মুহাররম মাস চন্দ্রবর্ষের প্রথম মাস ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় বহু মৌলিক ইবাদাতের সাথে চন্দ্র বর্ষের সম্পর্ক থাকায় মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবন হৃদয়ের সাথে এর গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান কুরআনের ভাষায় সৃষ্টির শুরু থেকেই যে চার টি মাস-কে আরবাআতুন হুরুমবা সম্মানিত চার মাস আখ্যায়িত করা হয়েছে মুহাররম মাস তার অন্যতম আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ

إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِندَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ ۚ فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنفُسَكُمْ ۚ وَقَاتِلُوا الْمُشْرِكِينَ كَافَّةً كَمَا يُقَاتِلُونَكُمْ كَافَّةً ۚ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ [٩:٣٦]

-“নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গননায় মাস বারটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। আর মুশরিকদের সাথে তোমরা যুদ্ধ কর সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে। আর মনে রেখো, আল্লাহ মুত্তাকীনদের সাথে রয়েছেন। {সূরা তওবা-৩৬}

হযরত আবু বাকরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ যেদিন আসমান যমীন সৃষ্টি করেন, সেদিন যেভাবে কাল [যমানা] ছিল তা আজও অনুরূপভাবে বিদ্যমান। বারমাসে এক বছর, তন্মধ্যে চার মাস পবিত্র। যার তিন মাস ধারাবাহিক যথা জিলকদ, জিলহজ্ব ও মুহাররম ও মুযার গোত্রের রজব, যা জামাদিউস সানী এবং শাবান মাসের মধ্যবর্তী। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৪৬৬২, ৪৩৮৫, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৬৭৯, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-১৯৪৭}

মুহাররম মাসের ফজিলত সম্পর্কে সম্পর্কে হাদীস শরীফে বহু বর্ণনা লিপিবদ্ধ রয়েছে এসব ফজিলতের আলোকে মুসলিম উম্মাহর জন্য এ মাসের সুনির্দিষ্ট সুন্নাহ মোতাবেক আমল হল- আশুরার সিয়াম আশুরার রোজার ফজিলত প্রসংগে বর্ণিত হাদীস থেকে করেকটি নিম্নে পেশ করা হল

হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু
-কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমযানের পর আর কোন মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোযা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জনৈক সাহাবী করেছিলেন, তখন আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘রমযানের পর যদি তুমি রোযা রাখতে চাও, তবে মুহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’-[জামে তিরমিযীঃ ১/১৫৭]

হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার রোজা রাখলেন এবং (অন্যদেরকে) রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! এটিতো এমন দিন, যাকে ইহুদি খ্রিষ্টানরা বড় জ্ঞান করে, সম্মান জানায়। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আগামী বছর এদিন আসলে, আমরা নবম দিনও রোজা রাখব ইনশাল্লাহ। বর্ণনাকারী বলছেন, আগামী বছর আসার পূর্বেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাত হয়ে গিয়েছে। -{সহিহ মুসলিম}

হযরত আবু কাতাদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহর নিকট আমার আশা হলো তিনি আশুরার দিনের রোযার বিনিময়ে এক বছরের পূর্বের গুনাহ মাপ করে দিবেন। -{সহিহ মুসলিম}

হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ রমজানের পর শ্রেষ্ঠ রোযা হলো আল্লাহর মাস মুহাররামের রোযা। -{সহিহ মুসলিম}

হযরত ইবনে রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে আশুরার দিনের মতো গুরুত্ব ও মর্যাদা দিয়ে অন্য কোন দিনে রোযা রাখতে দেখিনি। -[বোখারীঃ ২০০৬, মুসলিমঃ ১১৩২] 

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা আশুরার দিনে রোযা রাখবে কিন্তু ইয়াহুদীদের চেয়ে ভিন্নতর এবং ব্যতিক্রম করে রাখবে। আর্থাত (ওরা শুধু আশুরার দিন রাখে, তোমরা) তার আগে বা পরে আরেকটি রোযা যোগ করবে। -[মুসনাদে আহমাদঃ ১/২৪১, ইবনে খুজাইমাঃ ২০৯৫]

মুসলিম উম্মাহর জন্য এ মাসের একটি মারাত্মক শোকাবহ ঘটনা হল কারবালা প্রান্তরে হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং তার সংগী-সাথীদের মর্মান্তিক শাহাদাত মুসলিম শাসকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সুন্নাহ মোতাবেক কি ধরণের ভূমিকা পালন করতে হবে, এ শাহাদাতের মাধ্যমে ভবিষ্যত মুসলিম উম্মাহর জন্য তাঁর বাস্তব শিক্ষা ও দিক-নির্দেশনা রেখে গেছন

বলাবাহুল্য যে, উম্মতের জন্য এই শোক বহণ করা দুসাধ্য উম্মাহর জন্য কর্তব্য হল শোক-কে শক্তিতে পরিনত করা এবং তাদের রেখে যাওয়া শিক্ষা ও দিক-নির্দেশনা জীবনের পাথেয় হিসাবে গ্রহণ করা এ প্রসংগে হাদীস শরীফে পূর্বেই দিক-নির্দেশনা বর্ণিত রয়েছ যেমন-

হযরত উম্মু সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিতনবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : অচিরেই তোমাদের উপর এমন কতিপয় শাসক হবে যাদের কিছু কাজ (শারীয়াত অনুযায়ী হওয়ার কারণে) তোমরা পছন্দ করবে আর কিছু কাজ (শারীয়াত বিরোধী হওয়ার কারণে) অপছন্দ করবে। যে ব্যক্তি অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করবে সে দায়িত্বমুক্ত হবে। আর যে ব্যক্তি এগুলোকে ঘৃণা করবে সেও দায়িত্বমুক্ত হবে। কিন্তু যে ব্যক্তি এরূপ কাজের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে এবং তার অনুসরণ করবে সে অন্যায়ের ভাগী হবে। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবো না? তিনি বললেন : না, যতক্ষন তারা তোমাদের মাঝে নামাজ কায়েম করে”- (মুসলিমঃ হাদীস নং ৪৬৪৯ ও তিরমিযীঃ হাদীস নং ২২১১)

আহলে বাইত ইসলামের মহান নিদর্শন, তাদের প্রতি মহব্বত ইমানের অন্যতম লক্ষণ আর তাদের প্রতি দুশমনি মুলত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে দুশমনি হিসাবে গণ্য শাহাদাতের মর্মান্তিক ঘটনায় নিশ্চয়ই চোখ অশ্রুসজল হয়, হৃদয় ব্যথিত হয়, তবে আবেগের বশে মুখে এমন কিছু উচ্চারণ করা বা এমন কোন কাজ করা উতিত নয়- যা আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয়। যেমন-

হযরত আবূ বুরদা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আবূ মূসা রাদিয়াল্লাহু আনহু রোগ যন্ত্রণায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন, তখন তাঁর মাথা পরিবারস্থ কোন এক মহিলার কোলে ছিলমহিলাটি চেঁচিয়ে কান্না করতেছিলকিন্তু তার কান্না বন্ধ করার মত শক্তি তাঁর ছিল নাপরে যখন তিনি হুঁশ ফিরে পেলেন তখন বললেন: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদের থেকে মুক্ত আমিও তাদের থেকে মুক্তবন্তুতঃ তিনি সেসব নারীদের থেকে মুক্ত যারা শোকে বিলাপ করে, মাথা নেড়া করে এবং কাপড় ছেঁড়ে” [মুত্তাফাকুন 'আলাইহি, বুখারী: ১২৯৬, মুসলিম: ১০৪]

সুতরাং শোকে বিলাপ করা, কাপড় ছেঁড়া, শরীর ক্ষত-বিক্ষত করা, আনুষ্ঠানিক শোক মিছিল ও শোক দিবস পালন করাইত্যাদি ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ব রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যামানা থেকে অদ্যাবধি সমস্ত হকপন্থি উলামাগণের মতে এ সব গর্হিত কার্যক্রম সমুহ বিদআত ও হারাম উল্লেখিত হাদীসের আলোকে তারা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উম্মাতভূক্ত নয় সুতরাং মুসলিম উম্মাহর সবাইকে এ ব্যাপারে খুবই সতর্ক ও সাবধান থাকতে হবে

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে তাঁর দ্বীনের খেদমতের জন্য কবুল করুন! রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবা (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-গনের আদর্শের উপর সর্বদা কায়েম রাখুন! তাঁদের বরকতময় জামাআতের সংগে আমাদের হাশর করুন! আ-মী-ন।






1 comment:

  1. আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সবাইকে তাঁর দ্বীনের খেদমতের জন্য কবুল করুন! রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবা (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-গনের আদর্শের উপর সর্বদা কায়েম রাখুন! তাঁদের বরকতময় জামাআতের সংগে আমাদের হাশর করুন! আ-মী-ন।

    ReplyDelete