Tuesday, June 3, 2014

পবিত্র রমজানের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ নসিহত


পবিত্র রমজানের যাবতীয় ফজিলত, বরকত ও নিয়ামত হাসিলের ল্ক্ষ্যে সম্মানিত ইমাম, মুয়াল্লিম, মুবাল্লিগ ও মুসল্লীগণের প্রতি কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ নসিহত

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা'য়ালার জন্য- যিনি রব্বুল আ'লামীনদুরদ ও সালাম রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি যিনি রহমাতুল্লিল আ'লামীন, তাঁর পরিবারবর্গ ও বংশধর, সাহাবায়ে কিরাম (রাদিআল্লাহু আনহুম) ও সালিহীন (র) বান্দাগণের প্রতিআমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই এবং মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর বান্দা ও তার রসুলনিশ্চয়ই শুভ পরিণতি মুত্তাকীনদের জন্য

বরকতময় মাহে রমজান সমাগত : রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে কল্যান ও বরকতময় পবিত্র মাহে রমজান আমাদের সামনে সমাগতআমাদের দায়িত্ব হবে মাহে রমজানকে তার যথাযথ মহিমার সাথে বরণ করা, এর হক যথাযথভাবে আদায় করা এবং আল্লাহর নৈকট্য, সন্তোষ ও মহব্বত অর্জনের ওয়াছিলা হিসাবে এর যথাযথ সদ্ব্যবহার করাএ ব্যপারে সকল পর্যায়ের ইমাম, মুয়াল্লিম, মুবাল্লিগ ও মুসল্লী ভাইদের কাছে কতিপয় পরামর্শ বিবেচনার জন্য পেশ করছিআশা করি এর গুরুত্ব অনুধাবন করে রমজান মাসকে আত্মগঠন, আত্মশুদ্ধি, তাকওয়া অনুশীলন এবং আল্লাহর নৈকট্য, সন্তোষ ও মহব্বত অর্জনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহন করবেন

ক) সিয়াম সাধনা : রমজান হচ্ছে সিয়াম সাধনার মাসআল্লাহ তায়ালা কুরআন নাজিলের সম্মানার্থে রমজানে সিয়াম পালন করা বিধিবদ্ধ করে দিয়েছেন এবং এর বিনিময়ে মুমিনীন বান্দাগণের তাকওয়া অর্জনের কথা ঘোষণা করেছেনতাকওয়া হচ্ছে আল্লাহর অলি বা বন্ধু হওয়ার অন্যতম হাতিয়ারসুতরাং আমাদের সবাইকে যথাযথ মর্যাদার সাথে সিয়াম পালনসহ তাকওয়া ভিত্তিক জীবন গঠনের জন্য সাধনা করতে হবে, যাতে বিগত জীবনের গুনাহ মাফ হয়ে যায় এবং ভবিষ্যত জীবন তাকওয়ার ভিত্তিতে অতিবাহিত করার জন্য রুহানী শক্তি হাসিল করা যায়

খ) কুরআন শিক্ষা : রমজান হচ্ছে কুরআন নাযিলের মাসসুতরাং এ মাসে সবাইকে সহীহ তিলাওয়াত শিক্ষা দান ও শিক্ষা গ্রহনের কাজে সময় ব্যয় করা অতীব জরুরীযাদের সহীহ তিলাওয়াতে এখনো সমস্যা আছে তারা অবশ্যই তিলাওয়াত সহীহ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন এবং তারাবীহ নামাজের জামাতে নিয়মিত তিলাওয়াত শুনবেনযাদের সহীহ তিলাওয়াত জানা আছে তার অন্তত একবার নিজে কুরআন পূর্ণ খতম করবেন এবং তারাবীহ জামাতে একবার কুরআন খতম শুনবেনহাফিজগণ এ মাসে তাঁদের হিফজ আরও পাকা করে নিবেন

গ) পারিবারিক তালীম : রমজান মাসে সবার মন অধিকতর আল্লাহমুখী হয়ইমাম, মুয়াল্লিম, মুবাল্লিগ ও মুসল্লীগণ এ মাসে স্বীয় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দৈনিক কিছু সময় তালীমের ব্যবস্থা করবেনপবিত্র কুরআন ও ছুন্নাহর উপর আমল এবং তাকওয়া ভিত্তিক জীবনধার গড়ে তোলার মাধ্যমে সাহাবা (রা)-গনের পরিবারের নমুনায় স্বীয় পরিবারকে গড়ে তোলার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবেনরমজানে পারিবারিক তালীমের ব্যাপারে একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে রমজানের পরেও তা অব্যহত রাখা সহজ হয়ে যাবেফলে পরিবারসমূহ হিদায়াতের নুরে আলোকিত হবে

ঘ) নফল নামাজ : তাহাজ্জুদ নামাজ হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাগণের নিয়মিত আদত- যার মাধ্যমে নেক কাজ করা এবং গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার শক্তি লাভ করা যায়রমজান মাসে সেহরীর সময় নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় করা খুবই সহজতাহজ্জুদের নিয়মিত অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য রমজান মাসকে প্রশিনের মাস হিসাবে গ্রহন করতে হবে এবং পরবর্তীতে এ অভ্যাস নিয়মিত জারী রাখার জন্য অবিরাম সাধনা করতে হবেতাহলেই আল্লাহর সন্তোষ, মহব্বত ও নৈকট্য অর্জনের পথে সাধনা করা আমাদের জন্য সহজ হবেএছাড়া প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে জেগে বাইরে কাজে বের হওয়ার আগে নিয়মিত চাশতের নামাজের আদায় করা যায়

ঙ) যাকাত আদায় : রমজান মাসে যাকাতের হিসাব করা ও আদায় করা খুবই উত্তম যদিও যে কোন মাসেই যাকাতের হিসাব করা যায়কারণ  রমজানে একটি ফরজ আদায় অন্যান্য মাসে সত্তরটি ফরজ আদায়ের মান মর্যাদা রাখেতাই প্রতি বছর ১লা রমজানকে যাকাত বর্ষের শুরু গণ্য করে সে অনুসারে যাকাতের যথাযথ হিসাব ও আদায় করা যায়যাকাত সম্পদকে পবিত্র ও সুরতি করেসমাজকল্যাণমূলক কাজের অন্যতম উস হল যাকাত এ মাসে সমাজ কল্যাণে পরিকল্পিত অর্থব্যয় (যেমন, অভাবীদের দ্বীনি কাজে সাহায্য, ছাত্র বৃত্তি, স্বল্পপুজির কর্মসংস্থান, চিকিসা সাহায্য, ঋন পরিশোধে সহায়তা, মৃত্যের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা) করা বড় সওয়াবের কাজ

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহে অনেক পরিবারের একমাত্র উপার্জনম ব্যক্তি শহীদ হয়েছেনচিরতরে পঙ্গু হয়েছেন - সম্মানজনকভাবে সে সব পরিবারের পুনর্বাসন করা স্থানীয় মুসলমানদের পবিত্র দায়িত্বএছাড়া দেশের সম্মানিত ওলামাগণের সাথে জনগোষ্ঠির একটি অংশের দুরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় ইয়াতিমখানা ও লিল্লাহ বোডিং-এ যাকাত কালেকশন এ বছর কমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছেএমতাবস্থায় যারা ওলামায়ে কেরাম, তলেবে ইলম  এবং দ্বীনি প্রতিষ্ঠানসমূহের ইয়াতিখানা ও লিল্লাহ বোডিং মহব্বত করেন, তাদেরকে এসব খাতে বিগত বছরের তুলনায় দ্বিগুন/ ত্রিগুন হারে যাকাত প্রদান করে উক্ত ক্ষতি পুষিয়ে দেওযার জন্য এগিয়ে আসতে হবে

ছ) সার্বক্ষনিক জিকির : রমজান মাসে যাবতীয় বেহুদা কথা ও কাজ পরিহার করে সার্বনিকভাবে আল্লাহর জিকিরের হালতে অতিবাবিহত করতে হবেদোয়ায়ে মাসনুন, অন্যান্য অজিফা আদায় নিয়মিত অভ্যাসে পরিনত করতে হবেতর্ক-বিতর্ক সর্বদা এড়িয়ে চলতে হবেরমজান ও ঈদের কেনা-কাটার কাজ যতটা সম্ভব রমজানের আগেই সারতে হবেএকান্ত জরুরী কাজ ছাড়া রমজান মাসকে কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যই খাস করে নিতে হবে এবং তাঁর নৈকট্য, সন্তোষ ও মহব্বত অর্জনের সাধনায় নিজেকে সার্বক্ষনিকভাবে নিয়োজিত করতে হবে

ছ) ইফতার মাহফিল : যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করায় সে ঐ রোজাদারের সমান সওয়াব লাভ করেতাই এ মাসে বেশী বেশী করে ছোট ছোট ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা যায়ইফতার মাহফিলে ও আপ্যায়নে দরিদ্রদের প্রতি বেশী গুরুত্ব দিতে হবেইমাম, মুয়াল্লিম, মুবাল্লিগ ও মুসল্লীগণ পারিবারিকভাবে অন্তত একটি করে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে দ্বীনি আলোচনাসহ ইফতারী ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে আল্লাহ তায়ালার অগনিত রহমত, বরকত ও নিয়ামত লাভের সৌভাগ্য অর্জনের ল্েয সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে

জ) অন্যান্য ইবাদাত : সলাতুত তারাবীহ এ মাসের বিশেষ উপহার- এ ব্যপারে সবাইকে যত্নবান হতে হবেসলাতুত তারাবীহ কত রাকাআত এই বিতর্ক এড়িয়ে চলতে হবেএ মাসের নফল ইবাদাত অন্যান্য মাসের ফরজ ইবাদাতের সমান মর্যাদা রাখেতাই এ মাসে বেশী বেশী নফল নামাজ আদায় করা যায়তবে যাদের যিম্মায় উমুরী কাজা আছে তাদেরকে নফল নামাজের পরিবর্তে উমুরী কাজা আদায়ে বেশী যত্নবান হতে হবেসম্ভব হলে এমাসে একবার সালাতুত তাসবীহ আদায় করা যায়এ ছাড়া বেশী বেশী নফল দান-সদকাও করা যেতে পারেতবে যাদের ঋণ আছে তাদের নফল দানের চেয়ে ঋণ পরিশোধেই অধিকতর যত্নবান হওয়া উচিৎ

ঝ) হক্কুল ইবাদ : হক্কুল ইবাদ দুই প্রকার। (১) যা পরিশোধযোগ্য- এ থেকে মুক্তি পেতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির হক পরিশোধ বা মাফ করিয়ে নিতে হবে, তার কাছে মাফ চাইতে হবে এবং সাথে সাথে আল্লাহর কাছেও তওবা-মা প্রার্থনা করতে হবে। (২) যা পরিশোধযোগ্য নয় : এ থেকে মুক্তি পেতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে মাফ চাইতে হবে এবং সাথে সাথে আল্লাহর কাছেও তওবা-ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবেকারও হক নষ্ট হয়ে থাকলে এ মাসে অবশ্যই তা পরিপূরণে যত্নবান হতে হবেশুধুমাত্র তওবার দ্বারা হক্কুল ইবাদ ও ঋণ মাফ হয় নাকারও দ্বারা আমাদের হক নষ্ট হয়ে থাকলে কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টীর আশায় আমরা ক্ষমা করে দিতে পারি

ঞ) ইতিকাফ প্রোগ্রাম : রমজান হল লাইলাতুল কদরের মাস- যা হাজার মাস থেকেও উত্তমআর এ রাতের নিয়ামত ও বরকত পরিপূর্ণভাবে হাসিল করতে হলে রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতে হবেদায়িত্বশীলগন এলাকার মুয়াল্লিম ও মুবাল্লিগগণকে নিয়ে শেষ দশকে ইতিকাফ করবেনযারা দশদিন বসতে অপারগ তারা যতদিন পারেন নফল ইতিকাফের নিয়াতে বসবেন, অন্তত রাত্রগুলো মাসজিদে ইবাদাতে কাটাবেন

মনে রাখবেন! এ মাস আল্লাহর খাস মাস! তাকওয়া অর্জনের মাস! রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস! আখিরাতের ফসল তোলার মাসসে ব্যক্তি ব্যর্থ হল- যে ব্যক্তি এ মাস পেয়েও তার গোনাহসমূহ মাফ করাতে পারল নাছুন্নাহ মোতাবেক জীবন গঠনের জন্য এ মাসকে সাধনার মাস হিসাবে গ্রহন করতে হবেহারাম ও মাকরুহ বর্জনের সাথে সাথে যে কোন সন্দেহজনক বিষয় ও কাজ সর্বদা এড়িয়ে চলতে হবেমুবাহ বা জায়েজ এর বিস্তীর্ণ ময়দান ও পথ থেকে ছুন্নাতের নির্দিষ্ট গন্ডি ও পথের মাঝে সবাইকে ফিরে আসতে হবেতাহলেই তাকওয়া অর্জন সম্ভব হবে, আল্লাহর খাঁটি বান্দাহ হওয়া যাবে এবং জীবনের সব কাজই ইবাদাত হিসাবে গণ্য হবে
 
আল্লাহ আমাদের মধ্যকার জীবিত ও মৃত সবাইকে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত দান করুন! আমাদেরকে ও কিয়ামত পর্যন্ত আমাদের বংশধরগণকে কুরআন ও ছুন্নাহ মোতাবেক জীবন গঠন করার তৌফিক দান করুন! তাঁর দ্বীনের খিদমতের জন্য কবুল করুন! তাঁর দ্বীনের পথে অবিচল থাকার এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার তৌফিক দান করুন! দুনিয়ার প্রবঞ্চনা, নাফসের খাহিসাত, শয়তানের ধোকা, জালিমদের জুলুম, বিপদ ও মুসিবত এবং যাবতীয় ফিৎনা থেকে হিফাজাত করুন! তাঁর মাহবুব বান্দাহ ও তাঁর হাবীবের মাহবুব উম্মাহগণের অন্তর্ভূক্ত করুন এবং রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবাগণের সাথে আমাদের হাশর করুন! আ-মী-ন



No comments:

Post a Comment