রূহের মন্ত্রণালয় (কলব)-এর পরিচয় ও
চিকিৎসা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা'য়ালার জন্য যিনি রব্বুল
আলামীন। দুরুদ ও সালাম রসূলুল্লাহ্ সল্লালাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি যিনি রহমাতুল্লিল আলামীন, তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কিরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) এবং সালেহীন (র)-গণের প্রতি। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই। আমরা আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সল্লালাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর বান্দাহ ও রসূল। নিশ্চয়ই শুভ পরিণতি শুধুমাত্র মুত্তাকীনদের জন্য নির্ধারিত।
রূহের মন্ত্রনালয় কলবের পরিচয়ঃ
কলবের সংজ্ঞা : কলব বা অন্তঃকরণ হল- দেহের মুল অংশ, যার মাধ্যমে রূহ দেহের সাথে সংযুক্ত হয়। কলব হল কম্পিউটারের হার্ডডিস্কের ন্যায়, যা নুরানী পর্দার মাধ্যমে রূহের সাথে এবং জৈবিক পর্দার মাধ্যমে নাফসের সাথে
সংযুক্ত থাকে। কলবের সংজ্ঞা প্রসংগে রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : নিশ্চয়ই মানুষের দেহে এক টুকরা গোশত আছে, যখন তা পবিত্র হয় তখন সমস্ত দেহই পবিত্র হয়ে যায়, আর যখন তা অপবিত্র হয়ে যায় তখন সমস্ত দেহই অপবিত্র হয়ে যায়, আর জেনে রাখ তা হল ক্বলব। (বুখারী ও মুসলিম)
কলবের পরামর্শদাতা : আল্লাহ, সংগীয় ফিরিশতা, বিবেক, ভাল মাতা-পিতা, ভাল অভিভাবক, ভাল স্বামী-স্ত্রী, ভাল আত্মীয়-স্বজন, ভাল বন্ধুমহল, ভাল পরিবেশ থেকে কলবের মধ্যে সর্বদা ভাল পরামর্শ ও নসীহত
প্রেরিত হয়। আবার তাগুতী শক্তি, সংগীয় শয়তান, রিপুসমূহ, দেহের কামনা, খারাপ মাতা-পিতা-অভিভাবক, খারাপ নেতা, খারাপ স্বামী-স্ত্রী, খারাপ আত্মীয়-স্বজন, খারাপ বন্ধুমহল ও খারাপ
পরিবেশ কলবের মধ্যে সর্বদা খারাপ পরামর্শ ও ওয়াসওয়াসা প্রদান করে থাকে।
কলবের তথ্য আদান-প্রদান : কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক
যেমন মাউস, কিবোর্ড, ভয়েস কমান্ড, ড্রাইভ, সিডি, স্ক্যানার ও ইন্টারনেট
ইত্যাদির মাধ্যমে তথ্য গ্রহণ এবং সিপিইউ এর মাধ্যমে মনিটর, প্রিন্টার, সাউন্ড বক্স, ফ্যাক্স ও নেটে তথ্য প্রদান
করে তেমনি কলব নামক হার্ড ডিস্ক ইন্দ্রীয়, অতিন্দ্রীয় ও রূহানী
প্রক্রিয়ায় তথ্য গ্রহণ করে এবং নাফস নামক সিপিইউ এর মাধ্যমে ইন্দ্রীয় প্রক্রিয়ায়
নিজ মনে ও দেহের বিভিন্ন অংগে এবং অতিন্দ্রীয় ও রূহানী প্রক্রিয়ায় দুরবর্তী স্থানে
অন্যের হৃদয়-মনে তথ্য, কমান্ড, পরামর্শ ও ফায়েজ প্রেরণ করে
থাকে।
কলব-রূহের সংযোগ : মাতৃগর্ভে শুক্রানু ও
ডিম্বানুর মিলনের মাধ্যমে সন্তানের সুত্রপাত হতে হলে তার জন্য রূহ নির্দিষ্ট থাকতে
হবে। সংশ্লিষ্ট রূহ আল্লাহর হুকুমে রিমোট
কন্ট্রোলে মাতৃগর্ভে তার বসবাসের উপযোগী দেহ তৈরীতে ভূমিকা রাখে। ৪০ দিনের মধ্যে সর্বপ্রথম কলব তৈরী হয়। ১২০ দিনে যখন দেহটি পূর্ণাংগ আকৃতি পায়, তখন আল্লাহ তা'য়ালা দেহের সাথে রূহের সংযোগ স্থাপনের জন্য রূহটিসহ জনৈক
ফিরিশতাকে প্রেরণ করেন। কলব ও রূহের সংযোগস্থলে নাফস
তৈরী হয়। ফিরিশতা তখন আল্লাহর হুকুমে কতিপয় ইলহাম ও
তাকদীর (যেমন- হায়াত, মৃত্যু, রিজক ইত্যাদি) নাফস-এর মাঝে
সেট-আপ করে দেন। মূল সংযোগ কলবের সাথে হলেও দেহের সর্বত্র
এর প্রভাব বিস্তৃত হয়।
কলবের রোগের কারণ : দুনিয়ায় আগমনকালীন
রূহ-কলব-নাফস সবই পরিশুদ্ধ থাকে এবং সন্তান ইসলামের উপর জন্ম নেয়। পরে রূহের তিন অবস্থার মত কলবেরও তিন
অবস্থার যে কোন এক অবস্থায় পরিণতি লাভ করে।
রোগগ্রস্থ কলব : আল্লাহর নাফারমানী, নাফসের তাবেদারী ও দুনিয়ার মহব্বতে নানাবিধ পাপের কারণে কলবের উপর দাগ পড়তে
থাকে, ফলে কলব ক্রমাগত অন্ধকারাচ্ছন্ন ও অসুস্থ হতে থাকে। কলবের এই অসুস্থতা নাফসের মাধ্যমে
কামনা-বাসনা, চরিত্র ও আচরণে প্রকাশিত হয়। কিন্তু বিবেকের সতর্কতা ও কলবের নসিহত গ্রহণ করার মতা
একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায় না। কলবের এই অবস্থাকে রোগগ্রস্ত কলব বলে। যারা নাফসে লাউয়ামা পর্যায়ের পাপী মু’মিন তাদের কলব হল রোগগ্রস্থ্ কলব। যেমন-
وَأَمَّا الَّذِينَ
فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ فَزَادَتْهُمْ رِجْسًا إِلَى رِجْسِهِمْ وَمَاتُوا وَهُمْ
كَافِرُونَ
আল্লাহ তা'য়ালা বলেন : আর যাদের অন্তরে
রোগ আছে, তা তাদের কলুষের সাথে (ক্রমাগত পাপের কারণে) আরও কলুষ
বৃদ্ধি করেছে। (সূরা তওবাহ : আয়াত-১২৫) তিনি আরও বলেন :
كَلَّا بَلْ رَانَ
عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ
- কখনও না, বরং তাদের অন্তরসমূহে তাদের
কৃত পাপের কারণে মরিচা ধরেছে। (সূরা মুতফফিফীন : আয়াত-১৪) তিনি আরও বলেন :
فَتَرَى الَّذِينَ
فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ يُسَارِعُونَ فِيهِمْ يَقُولُونَ نَخْشَى أَنْ تُصِيبَنَا
دَائِرَةٌ فَعَسَى اللَّهُ أَنْ يَأْتِيَ بِالْفَتْحِ أَوْ أَمْرٍ مِنْ عِنْدِهِ
فَيُصْبِحُوا عَلَى مَا أَسَرُّوا فِي أَنْفُسِهِمْ نَادِمِينَ
-যাদের কলবের মধ্যে ব্যাধি রয়েছে, আপনি দেখবেন, তারা অতি দ্রুত ইহুদি-খৃষ্টান-মুশরিকদের সাথে মিলিত হবে। তারা বলবে : আমরা আমাদের উপর যে কোন রকমের
বিপদ আপতিত হওয়ার আশংকা করি। অচিরেই আল্লাহ বিজয় দান করবেন কিংবা তাঁর নিজের প থেকে এমন
কিছু দেবেন যাতে তারা অন্তরে যা লুকিয়ে রেখেছিল সে জন্য লজ্জিত হবে। (সূরা মায়িদা : আয়াত-৫২)
মোহরাংকিত কলব : রোগগ্রস্থ কলব ক্রমাগত পাপের কারণে কলবের
উপর দাগ পড়তে পড়তে সম্পূর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। তাদের কৃতকর্ম ও আল্লাহ দ্রোহীতার কারণে শক্ত আবরণে ঢেকে
যায়। ফলে আল্লাহর প থেকে তাদের কলব সিলগালা করে
দেয়া হয়। বিবেকের সতর্কতা ও নসিহত গ্রহণ করার মতা
একেবারে হারিয়ে যায়। কলবের এই অবস্থাকে বলা হয়
মোহরাংকিত কলব। এ হল নাফসে আম্মারা সাথে সংশ্লিষ্ট
মুনাফিক, তাগুত, কাফির, মুশরিক, ইহুদী, নাসারা ও জালিমদের কলব। যেমন, আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا سَوَاءٌ عَلَيْهِمْ أَأَنْذَرْتَهُمْ أَمْ لَمْ
تُنْذِرْهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ ০ خَتَمَ اللَّهُ عَلَى قُلُوبِهِمْ وَعَلَى سَمْعِهِمْ وَعَلَى
أَبْصَارِهِمْ غِشَاوَةٌ وَلَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ
০
আল্লাহ তা'য়ালা বলেন : নিশ্চয়ই যারা
কাফির, আপনি তাদেরকে সতর্ক করুন অথবা না করুন, তাদের জন্য দুটোই সমান, তারা ঈমান আনবে না। আল্লাহ তাদের অন্তর ও কানসমূহের উপর (অবিরাম আল্লাহদ্রোহীতা
ও নাফারমানীর কারণে) মোহর মেরে দিয়েছেন, তাদের চোখসমূহের উপর রয়েছে
পর্দা এবং তাদের জন্য আছে চরম শাস্তি। (সূরা বাকারাহ : আয়াত ৬-৭) তিনি আরও বলেন :
وَلَقَدْ ذَرَأْنَا لِجَهَنَّمَ كَثِيرًا مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ لَهُمْ قُلُوبٌ لَا يَفْقَهُونَ بِهَا وَلَهُمْ أَعْيُنٌ لَا يُبْصِرُونَ بِهَا وَلَهُمْ آَذَانٌ لَا يَسْمَعُونَ بِهَا أُولَئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ أُولَئِكَ هُمُ الْغَافِلُونَ
-আর আমি বহু জ্বিন এবং মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি
করেছি। তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তারা তা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে না, তাদের চোখ আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখার চেষ্টা করে না, তাদের কান আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনার চেষ্টা করে না। তারা পশুর মত, এমনকি পশুর চেয়েও বেশি
নিকৃষ্ট। বস্তুত তারাই উদাসীন। (সূরা আরাফ : আয়াত-১৭৯)
নিস্কলুষ কলব : রোগগ্রস্থ কলব যখন উপযুক্ত চিকিৎসা ও
সাধনার মাধ্যমে রোগমুক্ত, পবিত্র ও আয়নার মত পরিষ্কার
হয়ে যায়, তখন ঐ কলবকে কলবুন সালীম বা নিষ্কলুষ কলব বলা হয়। কলবের এ অবস্থা হল নাফসে মুতমাইন্নাহ এর
সাথে সংশ্লিষ্ট খাঁটি মুমিনগণের কলব। যেমন, আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُون ০ إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ
০
যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে আসবে না, শুধু সে-ই উপকৃত হবে যে আল্লাহর কাছে পরিশুদ্ধ কলব নিয়ে হাজির হবে। -(শুয়ারা : আয়াত ৮৮, ৮৯)
মনে রাখবেন! তাকওয়া ভিত্তিক গঠিত, রোগমুক্ত, পবিত্র ও নিষ্কলুষ কলব আল্লাহ
তা'য়ালার বিরাট নিয়ামত এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সর্বশ্রেষ্ঠ
সম্পদ। কলব চিকিৎসার জ্ঞান অর্জন এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সবার জন্যই ফরজ। কারণ, আল্লাহর দরবারে কলবুন সালীম
বা নিষ্কলুষ কলব ছাড়া কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়।
কলবের রোগের চিকিৎসা
কলবের চিকিৎসার জন্য প্রথমেই একটি সুস্থ কলব বা কলবুন সালীম
এর গুণ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে। তা হল হুব্বুল্লাহ, ইয়াকীন, ইখলাস, তাকওয়া, ইহসান, সিদ্ক, তাওয়াক্কুল, সবর, শোকর, তাফওয়ীজ, রেজা বিল কাযা, তাসলিম ইত্যাদি। আর রোগাক্রান্ত কলবের মধ্যে
থাকে- হুব্বুদ্দুনিয়া, কিবর, রিয়া, কিজব, হাসাদ (হিংসা), হিরস (লালসা), বুগজ (অন্তরে শত্র“তা পোষণ), গজব (রাগ), বুখল (কৃপণতা), দীর্ঘ আশা, কীনা ইত্যাদি।
কলব চিকিৎসার জ্ঞান অর্জন এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সবার
জন্যই ফরজ। কারণ, আল্লাহর দরবারে কলবুন সালীম
ছাড়া কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। কলবুন সালীম অর্জনের জন্য কয়েক প্রকার চিকিৎসার ব্যবস্থা
নিতে হবে। শারীরিক রোগ চিকিৎসার কয়েকটি ধাপ আছে, যেমন- মৌলিক চিকিৎসা, লণের চিকিৎসা, রোগজনিত ক্ষতিপূরণ এবং
পুনর্বাসন। তেমনি কলবের রোগ চিকিৎসার জন্যও
কুরআন-ছুন্নাহর আলোকে অনুরূপ ধাপসমূহ অনুসরণ করতে হয়।
কলবের রোগের মৌলিক চিকিৎসা
রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
নিশ্চয়ই মানুষের দেহে এক টুকরা গোশত আছে, যখন তা যথার্থ রূপে পবিত্র হয়
তখন সমস্ত দেহই পবিত্র হয়ে যায়, আর যখন তা অপবিত্র হয়ে যায়
তখন সমস্ত দেহই অপবিত্র হয়ে যায়, আর জেনে রাখ তা হল ক্বলব। (বুখারী- মুসলিম) সুতরাং কলব পরিশুদ্ধ হলে
অংগ-প্রত্যংগসহ গোটা দেহ এবং তার সমস্ত কাজকর্ম পরিশুদ্ধ হয়ে যায়।
মৌলিক চিকিৎসা হল ঐ সমস্ত চিকিৎসা যা কলবের মরিচা বা কালিমা
দূর করার জন্য সরাসরি কলবের উপর প্রয়োগ করা হয়। ছুন্নাহ সম্মত পদ্ধতি হল-
০ আল্লাহর জিকির : আল্লাহর জিকির দ্বারা কলবের
মরিচা বা কালিমা দুর হয়ে যায় এবং কলব পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন : তারা এমন লোক, যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর যিকরে তাদের অন্তর প্রশান্ত হয়। হুঁশিয়ার! আল্লাহর স্মরণেই অন্তর প্রশান্ত
হয়। (সুরা রাদ : ২৮)
রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
প্রত্যেক জিনিস পরিস্কার করার জন্য যন্ত্র বা রেত আছে। আর কলবসমুহকে পরিষ্কার করার যন্ত্র হল আল্লাহর জিকির
(বায়হাকী, ইবনে আবী শাইবাহ, তাবরানী মিশকাত)
জিকির কয়েক প্রকার, যথা- (১) জিকরে আমালী- আল্লাহর স্মরণে নেক আমল করা। (২) জিকরে লিসানী- আল্লাহর স্মরণে কুরআন
তিলাওয়াত, তাসবীহ-তাহমীদ-তাহলীল-তাকবীর পাঠ, দুরূদ পাঠ, মাসনুন দোয়ার আমল, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা
ইত্যাদি। (৩) জিকরে কলবী- দাড়ানো, বসা, শায়িত সর্বাবস্থায় আল্লাহকে হাজির নাজির জানা। (৪) জিকরে মালী- আল্লাহর মহব্বতের আশায়
আল্লাহ প্রদত্ত মহব্বতের ধন-সম্পদ থেকে আল্লহর পথে দান করা।
০ তওবা ও ইস্তিগফার : হযরত আবু হুরাইরা
(রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যখন
কোন মু’মিন বান্দা গুনাহ করে তখন তার কলবের মধ্যে একটি দাগ পড়ে যায়। অতঃপর যদি সে তওবাহ ও ইস্তিগফার করে তাহলে
তার কলব পরিষ্কার হয়ে যায়। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)
০ মৃত্যুর স্মরন ও কুরআন তিলাওয়াত : হযরত ইবনে ওমর
(রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্র্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : নিশ্চয়ই কলবসমূহে মরিচা পড়ে যেমন লোহায় পানি লাগলে
মরিচা পড়ে। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসূল! এটা পরিষ্কার করার উপায় কি?
জবাবে তিনি বললেন : মৃত্যুকে
খুব বেশি স্মরণ করা আর কুরআন তিলাওয়াত করা।
০ রসূলের (স) মহব্বত ও ছুন্নাতের অনুসরণ : দুনিয়ায় প্রচলিত যাবতীয়
আইন-কানুন, বিধি-বিধান, রসম-রেওয়াজের মহব্বতের রোগে
রোগগ্রস্থ কলবের চিকিৎসার জন্য রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহব্বত ও ছুন্নাতের অনুসরণের মজবুত নিয়াত ও
কামনা-বাসনা কলবের মধ্যে জাগ্রত করতে হবে।
মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ (হে রসূল!) আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসো তাহলে আমাকে অনুসরণ কর। আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের
পাপসমূহ ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আলে ইমরান : আয়াত-৩১)
০ নিজ আমলের হিসাব গ্রহণ: নিজ আমলের হিসাব গ্রহণ
প্রসংগে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেকেই ভেবে দেখ, আগামী দিনের জন্য আগাম কী প্রেরণ করছ। আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা করছ, নিশ্চয়ই আল্লাহ সে সম্পর্কে
সবকিছু জানেন। (সূরা হাশর : আয়াত-১৮)
০ নাফ্সের (প্রবৃত্তির) অনুসরণ থেকে বিরত
থাকা : মানুষের বিবেক তাকে তার
প্রভুর সত্যিকার পরিচয় লাভের উপলব্ধি প্রদান করে আর মুমিনগণকে আল্লাহর কুরআন ও
রসূলের ছুন্নাহ মোতাবেক স্বীয় জীবন গঠনের জন্য অনুপ্রাণিত করে। সবার কর্তব্য হল সর্বদা নিজেকে সতর্ক করা, বিবেকের আহ্বানে সাড়া দেয়া এবং নাফসের (প্রবৃত্তির) অনুসরণ থেকে বিরত থাকা। এ প্রসংগে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ
- অতঃপর যে সীমালংঘন করে, পৃথিবীর জীবনকে অগ্রাধিকার দেয়, জাহান্নামই হবে তার আবাস। আর যে নিজ প্রতিপালকের সামনে উপস্থিত
হওয়ার ভয়ে প্রকম্পিত হয় এবং নাফ্সের (প্রবৃত্তির) অনুসরণ করা থেকে নিজেকে বিরত
রাখে জান্নাতই হবে তার বাসস্থান। -(সূরা নাযিয়াত : আয়াত ৩৭-৪১)
০ নাফসের হিসাব গ্রহণ : হযরত শাদ্দাদ ইবনে আওস
(রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : বুদ্ধিমান সেই
ব্যক্তি যে তার নাফসের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য কাজ করে। আর দুর্বল (নির্বোধ) সেই ব্যক্তি যে
নিজেকে কুপ্রবৃত্তির (নাফসের) গোলাম বানায়, আবার আল্লাহর কাছেও (রহমতের)
প্রত্যাশা করে। (তিরমিযী : হাসান-২৪০১)
০ সর্বদা আল্লাহকে হাজির নাজির জানা : সবার আল্লাহকে হাজির নাজির
জেনে যথাযথভাবে ভয় করে চলা উচিত । যেমন- আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ হে মুমিনগণ! তোমরা
আল্লাহকে ভয় কর যেমন ভয় তাঁকে করা উচিত এবং প্রকৃত মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ কর না। (সূরা আলে ইমরান : আয়াত-১০২)
০ কলবকে শয়তানের ওয়াস-ওয়াসা থেকে সর্বদা
হিফাজাত করা : হযরত ইবনে আব্বাস
(রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্র্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : শয়তান মানুষের কলবের মধ্যে আসন গেড়ে বসে থাকে। যখন সে আল্লাহর জিকির করে তখন শয়তান কলব
ছেড়ে পিছনে সরে যায়। আর যখন জিকির থেকে অমনোযোগী
হয়ে যায়, তখন আবার (কলবের মধ্যে) ওয়াস-ওয়াসা দিতে থাকে। (ইমাম বুখারী হাদিসটি বর্ণনা করেছেন)
০ ভাল কাজ দ্বারা খারাপ দূরীভূত করা : হযরত আবু যার (রাদিয়াল্লাহু
আনহু) থেকে বর্র্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন : তুমি যেখানেই থাক
আল্লাহকে ভয় কর। খারাপ কাজ হয়ে গেলে পরপরই ভাল কাজ কর, তাতে খারাপ (গুণাহের কালিমা) দূরীভূত হয়ে যাবে। আর মানুষের সাথে উত্তম ব্যবহার কর। (তিরমিযী-১৯৩৭ : হাসান ও সহীহ্)
০ তাহাজ্জুদ নামাজ : হযরত আবু উমামা
(রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
কিয়ামুল লাইল (তাহাজ্জুদ) তোমাদের উপর বিধিবদ্ধ করে নাও। কেননা তা হচ্ছে তোমাদের সলিহীন বান্দাগণের অভ্যাস ও ঐতিহ্য, তোমাদের প্রভুর নৈকট্য লাভের উপায়, গুণাহসমূহের কাফ্ফারা এবং
পাপসমূহের প্রতিবন্ধক। (তিরমিযী- ৩০৮০ : হাসান)
০ দান-সদাকাহ : দুনিয়া ও দুনিয়ার সম্পদের মহব্বতের রোগ
থেকে কলবকে চিকিৎসা করে সেখানে আল্লাহ তা'য়ালার মহব্বত জারী করার জন্য
বেশী বেশী দান-সদাকাহ করার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন। আল্লাহ তা'য়ালা বলেনঃ তোমরা কখনোই পুণ্য
ও কল্যাণ লাভ করবে না যতণ না তোমরা তোমাদের প্রিয়বস্তু (আল্লাহর পথে) ব্যয় করবে। আর তোমরা যা কিছু ব্যয় কর, সে ব্যয় সম্পর্কে আল্লাহ নিশ্চয় অবহিত রয়েছেন। (সূরা আলে- ইমরান : ৯২)
০ কলব সংশোধনের দোয়া : কলব সংশোধনের জন্য এবং
সংশোধিত কলবের উপর টিকে থাকার জন্য আল্লাহর কাছে সর্বদা প্রার্থনা করতে হবে। যেমন-
১) দ্বীনের পথে হিদায়াতের উপর টিকে থাকার জন্য আল্লাহর
শেখানো দোয়া :
رَبَّنَا لَا تُزِغ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ
هَدَيْتَنَا وَهَب لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ
- হে আমাদের প্রতিপালক! হিদায়াত প্রদান করার পর আপনি আমাদের
অন্তঃকরণকে বক্র করবেন না এবং আপনার নিকট থেকে আমাদেরকে অনুগ্রহ দান করুন! নিশ্চয়ই
আপনি সবকিছুর দাতা। (সূরা আলে ইমরান : আয়াত- ৮)
২) রসূলের শেখানো দোয়া : হযরত শাহর ইবনে হাওশাব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
আমি উম্মে সালমা (রা) কে
জিজ্ঞেস করলাম, হে উম্মুল মুমিনীন! রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম যখন আপনার কাছে অবস্থান করতেন তখন অধিকাংশ সময়ে তিনি কি দোয়া করতেন? তিনি বলেন, বেশীর ভাগ সময়ে তিনি এই দোয়া করতেন-
يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلى دِيْنِك
َ
- (হে অন্তর সমুহের ওলট-পালটকারী! আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের
উপর অবিচল রাখুন)- তিরমিযী : হাসান।
৩) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাদিয়াল্লাহু আনহু)
থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া করতেন :
اَللّهُمَّ مُصَرِّفَ الْقُلُوبِ صَرِّفْ قُلُوْبَنَا
عَلى طَاعَتِكَ
(- হে আল্লাহ! হৃদয় সমূহের
পরিবর্তনকারী! আমাদের হৃদয়গুলোকে আপনার আনুগত্যের দিকে ঘুরিয়ে দিন) ইমাম মুসলিম
হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
৪) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে
বর্ণিত। তিনি বলেন,
রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া করতেন :
اَللّهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ الْهُدى وَالتُّقى وَالْعَفَافَ
وَالْغِنى
(হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে
হিদায়াত, তাকওয়া, সচ্চরিত্রতা ও প্রাচুর্য্যতার
প্রার্থনা করছি) - ইমাম মুসলিম হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
সংশোধিত কলবের অবস্থা : সংশোধিত কলব আয়নার মত
পরিস্কার হয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে ইলহাম প্রাপ্ত হয়। আল্লাহর নুর সেখানে প্রতিফলিত হয়।
হযরত আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্র্ণিত। তিনি বলেন,
রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মাতদের মধ্যে অনেক মুহাদ্দাস
তথা ইলহামপ্রাপ্ত মানুষ ছিল। আর আমার উম্মাতের মধ্যে কেউ হয়ে থাকলে সে হল ওমর। - (ইমাম বুখারী হাদীসটি বর্ণনা
করেছেন)
হযরত আবু সায়ীদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্র্ণিত। তিনি বলেন,
রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : কামিল মু’মিনের ফিরাসাতকে
(অন্তর্দৃষ্টি) তোমরা ভয় কর। কারণ তিনি আল্লাহর নুর দ্বারা দেখেন ও নজর করেন। (তিরমিযী)
নাফসের (কলবের লক্ষণ ভিত্তিক)
চিকিৎসা
রোগাক্রান্ত কলবের লক্ষণ নাফস বা প্রবৃত্তির মাধ্যমে
কামনা-বাসনা, চরিত্র ও আচরণে প্রকাশিত হয়। তাই কলবের দোষ ও গুণসমূহকে অনেকে নাফসের দোষ-গুণ বলে
আখ্যায়িত করেছেন। তাই লক্ষনের চিকিৎসা হল- নাফস বা
প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা সংশোধন করার চিকিৎসা। সংশোধনের জন্য সাধনা করা একান্তভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব।
এ প্রসংগে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন : হে মুমিনগণ!
তোমাদের সংশোধনের দায়িত্ব তোমাদের নিজেদেরই উপর। তোমরা যদি সঠিক পথ অবলম্বন কর, তাহলে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহর কাছেই তোমাদের সকলের ফিরে আসা। এরপর তিনি সে সম্পর্কে জানাবেন যা তোমরা
করতে। (মায়েদা : ১০৫)
চিকিৎসা ও সাধনার মাধ্যমে নাফসকে মুতমাইন্নার স্তরে উপনীত
করার জন্য কুরআন ও ছুন্নাহ মোতাবেক অবিরাম সাধনা করতে হবে। পরামর্শ হল-
০ নাফসকে বিবেকের অনুগত করা : নাফসের মাধ্যমেই জীবনের সকল
কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। তাই সংশোধনের জন্য নাফসকে
বিবেকের অনুগত করতে হবে। রূহ ও দেহের সংযোগস্থলে জীবন
পরিচালনা শক্তি নাফস বা জীবাত্মা তৈরী হয়। আল্লাহ প্রেরিত ফিরিশতা যখন মাতৃগর্ভে এই সংযোগ স্থাপন করেন
তখন ঐ নাফসের মধ্যে আল্লাহর হুকুমে কিছু নির্ধারিত তথ্য সেট-আপ করে দেন। আল্লাহ ঐ নাফসকে সুবিন্যস্ত করেন এবং
তাকওয়ার পথ ও গোনাহের পথের সুস্পষ্ট জ্ঞান ইলহামের মাধ্যমে প্রদান করেন, যার নাম হল- বিবেক। বিবেক হল দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ
আদালত।
এই ইলহাম সম্পর্কে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন : শপথ আত্মার! এবং
তার, যা তিনি সুবিন্যস্ত করেছেন! অতঃপর তাকে তার খারাপ পথ ও
তাকওয়ার পথের এলহাম করেছেন। যে তাকে পবিত্র করল, সে সফল হল। আর যে তাকে কলুষিত করল, সে ধ্বংস হয়ে গেল। (সূরা আস-সামছ : ৭-১০)
সুতরাং নাফস বা প্রবৃত্তিকে চিকিৎসার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করে
নাফসে মুতমাইন্নার স্তরে উপনীত করতে হলে নাফসের কামনা-বাসনাকে আল্লাহ তা'য়ালা প্রদত্ত ইলহাম বা বিবেকের অনুগত করার জন্য অবিরাম সাধনা করতে হবে।
০ রূহানী চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ : নাফস বা প্রবৃত্তির চিকিৎসার
জন্য আল্লাহ ওয়ালাগণের পরামর্শ মোতাবেক সাধনা করা প্রয়োজন। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ আপনার আগে আমি ওহীসহ মানুষই প্রেরণ করেছিলাম। তোমরা যদি না জান তাহলে আহলুজ্জিকিরগণকে
(জ্ঞানী) জিজ্ঞাসা কর। (সূরা আম্বিয়া : ৭)
তিনি আরও বলেন : হে ঈমানদার বান্দাগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করে চল
এবং (তাকওয়া অর্জনের জন্য) সিদ্দিকীনগণের সংগী হও। (সূরা তওবা : ১১৯)
সুতরাং নাফসকে পরিশুদ্ধ করতে হলে আল্লাহওয়ালাগণের
তত্ত্বাবধানে কুরআন ও ছুন্নাহ মোতাবেক কয়েকটি ধাপ পাড়ি দিতে হবে। যথা-
·
সোহবাত
: সমস্ত আল্লাহওয়ালাগণের সংগে ভক্তি ও মহব্বতপূর্ণ সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং
সোহবাতের মাধ্যমে সর্বদা বরকত হাসিল করা।
·
বাইয়াত
: যে কোন একজন আল্লাহওয়ালা মুরব্বী বা রূহানী চিকিৎসকের হাতে কুরআন ও ছুন্নাহ
ভিত্তিক জীবন গঠন ও আনুগত্যের শপথ নেয়া।
·
ইতায়াত
: কুরআন ও ছুন্নাহ ভিত্তিক আনুগত্য করা, যাবতীয় পরামর্শ ও নির্দেশ
মেনে চলা এবং তার পরামর্শের আলোকে জীবন গঠন করা।
·
মুরাকাবা
: নিজ রূহ, কলব, নাফস, ঈমান ও আমল কুরআন ও ছুন্নাহ
মোতাবেক কিনা এবং বাইয়াতের উপর কায়েম কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা।
·
মুহাসাবা
: প্রতিদিন নিজ রূহ, কলব ও নাফসের কাছে আকিদা,
আমল, আখলাক, মুয়ামিলাতের ভাল-মন্দ দিকগুলোর হিসাব গ্রহণ করা।
·
মুজাহাদা
: কুরআন ও ছুন্নাহ ভিত্তিক জীবন গঠন এবং শাইখের আনুগত্যের উপর অবিচল থাকার জন্য
অবিরাম সাধনা করাই হল মুজাহাদা।
·
মুশাহাদা
: রূহ, কলব, নাফস, জাসাদ ও লিবাস যখন পরিশুদ্ধ
হয়ে যায়, জীবন আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হয়,
কলবে আল্লাহর নুরের প্রতিফলন
ঘটে, ইলহাম ও কাশফ হাসিল হয়, এরূপ অবস্থার উপর টিকে থাকার
সাধনা।
·
ফানা
ফির-রসূল : স্বীয় জীবন ও অন্য সব কিছু থেকে রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম অধিক প্রিয় হওয়া। নিজের পছন্দ-অপছন্দ, কামনা-বাসনা তাঁর আনীত
আদর্শের অনুগত হওয়া হল ফানা ফির-রসূল।
·
ফানা
ফিল্লাহ : একমাত্র আল্লাহর অস্তিত্বই সত্য, বাকি সব কিছু ধোঁকা। আল্লাহর অস্তিত্বের সামনে নিজের
পছন্দ-অপছন্দ, কামনা-বাসনা, অস্তিত্ব ও আমিত্ব সম্পূর্ণ বিলীন করে দেয়া। গোলামের কোন পছন্দ নেই, প্রভুর পছন্দই গোলামের পছন্দ- এ অবস্থা হল ফানা ফিল্লাহ।
·
বাকা বিল্লাহ : ফানার মাধ্যমে নিজের
অস্তিত্ব ও আমিত্ব সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর খাঁটি গোলামের পর্যায়ে দুনিয়ার
সমগ্র মাখলুকের উপর আল্লাহর খলিফার (শ্রেষ্ঠত্বের) মর্যাদায় নিজের অস্তিত্ব লাভ
করাই হল বাকা বিল্লাহ। ফলে মানুষ পাশবিকতার কেদমুক্ত
এবং মানবীয় গুনে গুনান্বিত প্রকৃত মানুষ হয়।
টার্গেট নির্ধারণ ভিত্তিক
নাফসের চিকিৎসা সাধনা
সাধনার পথ চলার ক্ষেেত্র সুনির্দিষ্ট টার্গেট নির্ধারণ করে
একই টার্গেটের পরস্পর সম্পর্কযুক্ত
মুনজিয়াত গুণাবলী অর্জন ও মুহলিকাত ত্র“টিসমুহ বর্জনের জন্য একত্রে
সাধনা করা যেতে পারে। এর কয়েকটি বাস্তব উদাহরণ সবার
বিবেচনার জন্য পেশ করা হল-
১) টার্গেট - রিদওয়ানুম মিনাল্লাহ
(আল্লাহর সন্তোষ) : এই টার্গেটে পৌঁছার একমাত্র বাহন হল ইখলাস। ইখলাসের বাহনে আরোহণ করে আল্লাহর হুকুম ও রসূলুল্লাহ্
সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তরিকা ভিত্তিক রিয়া ও কিব্র মুক্ত জীবন ধারা গড়ে
তোলার মাধ্যমে ঐ টার্গেটে পৌঁছার জন্য সাধনা করতে হবে।
২) টার্গেট - মাগফিরাত (ক্ষমা) : এই টার্গেটে পৌঁছার একমাত্র
বাহন হল তওবা। তওবার বাহনে আরোহণ করে সর্বদা আল্লাহ তা'য়ালার কাছে লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমা প্রার্থনার হালতে থাকতে হবে। নিয়মিত মুরাকাবা, মুহাসাবা ও মুজাহাদার মাধ্যমে এই মহান টার্গেটে পৌঁছার জন্য অবিরাম সাধনা
করতে হবে।
৩) টার্গেট - ইহসান : এই টার্গেটে পৌঁছার বাহন হল
তাকওয়া। তাকওয়ার বাহনে আরোহণ করে সর্বদা জিকিরে
আমালী, জিকিরে লিসানী ও জিকিরে কলবী এর মাধ্যমে ইহসানের ল্য
অর্জনের জন্য অবিরাম সাধনা করা।
৪) টার্গেট - রেজা বিল কাজা : এই টার্গেটে পৌঁছার বাহন হল
তাওয়াক্কুল। এ বাহনে আরোহণ করে সর্বদা সবর ও শোকর
ভিত্তিক জীবন ধারা অবলম্বন করে রেজা বিল কাজা ল্য হাসিল করার জন্য সাধনা করতে হবে।
৫) টার্গেট - নাসরুম মিনাল্লাহ (আল্লাহর
সাহায্য) : এই টার্গেটে পৌঁছার বাহন হল
আদল ও ইনসাফ। আদল ও ইনসাফ এর বাহনে আরোহণ করে সর্বদা
গজব, হাসাদ, হিরস, বোখল, বোগজ, হুব্বুদ্দুনিয়া ইত্যাদি
নিয়ন্ত্রণ করে আল্লাহ তা'য়ালার সাহায্য হাসিল করার জন্য অবিরাম সাধনা করতে হবে।
৬) টার্গেট - ফাদলাম মিনাল্লাহ (আল্লাহর
অনুগ্রহ) : এই টার্গেটে পৌঁছার বাহন হল
উত্তম আখলাক। উত্তম আখলাক এর বাহনে আরোহণ করে কুরআন ও
ছুন্নাহ ভিত্তিক সবার হক আদায়, উত্তম মুয়ামিলাত ও সমস্ত
মাখলুকের সাথে সদাচার এর মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ অর্জনের জন্য অবিরাম সাধনা করতে
হবে।
৭) টার্গেট - হুব্বুল্লাহ (আল্লাহর
মহব্বত) : এই টার্গেটে পৌঁছার বাহন হল
রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসরণ। রসূলের ইত্তিবা বা অনুসরণের বাহনে আরোহণ করে আল্লাহর
কিতাবের প্রতি মহব্বত, আল্লাহর রসূলের প্রতি মহব্বত,
আল্লাহর ঘরের প্রতি মহব্বত, আল্লাহওয়ালাগণের প্রতি মহব্বত, আল্লাহর জন্যই একে অপরের
প্রতি মহব্বত ও দুষমনী - এর মাধ্যমে আল্লাহ তা'য়ালার মহব্বত অর্জনের
টার্গেটে অবিরাম সাধনা করতে হবে।
মনে রাখবেন! নাফসে মুতমাইন্না আল্লাহ তা'য়ালার বিরাট নিয়ামত এবং দুনিয়া ও আখিরাতের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। নাফস বা প্রবৃত্তি চিকিৎসার জ্ঞান অর্জন এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সবার জন্যই
ফরজ। কারণ, আল্লাহর দরবারে নাফসে
মুতমাইন্না ছাড়া কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং নাফস বা প্রবৃত্তিকে
চিকিৎসার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করে নাফসে মুতমাইন্নার স্তরে উপনীত করতে হলে অবিরাম
সাধনা করতে হবে।
কলবের রোগজনিত ক্ষতিপূরণ ও
পুষ্টি সাধন
কলবের রোগ জনিত ক্ষতিপূরণ ও পুষ্টি সাধনের জন্য
ব্যক্তিগতভাবে কিছু পুষ্টিকর ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হয়। সাধনার পথের পথিককে এ ব্যাপারে ও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। এ ব্যাপারে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ
পেশ করা হল-
১) পবিত্রতা : পবিত্রতা অবলম্বন কলবকে আল্লাহমুখী, দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি এবং গুণাহ থেকে হিফাজত করে। অজু, গোসল ও তাইমুম দ্বারা বাহ্যিক পবিত্রতা অর্জিত হয়। হালাল পথে অর্জিত রিজিক দ্বারা শরীরের
রক্ত-মাংস পবিত্র হয়। নিষিদ্ধ ও বেহুদা চিন্তা, কামনা-বাসনা, কথা ও কাজ পরিহার এবং চুক্ষ,
কর্ণ, জিহ্বা ও লজ্জাস্থানের হিফাজত করার মাধ্যমে হৃদয় ও মন পবিত্র হয়।
২) ভাল বন্ধু : হযরত আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু)
থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বলেন : মানুষ তার বন্ধুর আদর্শে গড়ে উঠে। সুতরাং খেয়াল রাখা উচিৎ, সে কেমন লোককে বন্ধু বানিয়ে
নিচ্ছে। - (তিরমিযী,
আবু দাউদ)
৩) জুহুদ : হযরত আবুজার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে
বর্র্ণিত। তিনি বলেন,
রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে বান্দা দুনিয়াতে জুহুদ অবলম্বন করে অবশ্যই আল্লাহ
তার কলবের মধ্যে হিকমাত উৎপন্ন করে দেন, তার মুখে তা প্রকাশ করান, তাকে দুনিয়ার দোষত্র“টি, আত্মিক ব্যাধিসমূহ থেকে বাঁচার পথ দেখিয়ে দেন এবং দুনিয়া
থেকে নিরাপত্তাসহ বের করে জান্নাতে নিয়ে যান। - (বাইহাকী)
৪) ভাল সংসর্গ : রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন : নেককার লোকের সংসর্গ ও গোনাহগার লোকের সংসর্গের দৃষ্টান্ত হল
যথাক্রমে মেশ্ক বিক্রেতা ও কামারের হাঁপরে ফুঁক দানকারীর মত। মেশ্ক বিক্রেতার কাছে গেলে সে হয়ত তোমাকে এমনিতেই কিছু
লাগিয়ে দিবে, না হয় তুমি তার নিকট থেকে কিছু খরিদ করবে আর না হয় তুমি তার
নিকট থেকে অবশ্যই সুগন্ধ পাবে। আর কামারের হাঁপরে ফুঁক দানকারীর নিকটে গেলে হয়ত তোমার কাপড়
জ্বালিয়ে দেবে নতুবা অন্তত তার নিকট থেকে দুর্গন্ধ পাবেই। -(বুখারী ও মুসলিম)
৫) খিদমাতে খালক : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ
(রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : গোটা
সৃষ্টিকুল আল্লাহর পরিবার। অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহর পরিবারের সাথে সদয় ব্যবহার করে সে
আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয়। -(বায়হাকী)
আত্মশুদ্ধির সারমর্ম
মানব সত্তার পাঁচ অংশ : যে কোন ব্যক্তির পাঁচটি অংশ রয়েছে, যথা রূহ , কলব, নাফ্স, জাসাদ ও লিবাস । পরিশুদ্ধির জন্য সব অংশই পরিশুদ্ধ করতে
হবে।
১) রূহের পরিশুদ্ধি : গাইরুল্লাহর মহব্বত বর্জন
করে রূহকে (নিজেকে) সর্বদা আল্লাহর দিকে রুজু রাখলে রূহ আল্লাহর রঙে রঞ্জিত হয়, আল্লাহর নুরে আলোকিত হয়, ফলে রূহ পরিশুদ্ধ হয়ে আল্লাহর
মহব্বত লাভের যোগ্য হয়।
২) কলবের পরিশুদ্ধি : আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমেই
কলব পরিশুদ্ধ হয়। আল্লাহকে সর্বদা হাজির-নাজির জানা, সার্বণিক জিকির, কুরআন তিলাওয়াত, মৃত্যুর স্মরণ, তওবা ও ইস্তিগফার -এর মাধ্যমে কলব পরিশুদ্ধ করতে হয়।
৩) নাফসের পরিশুদ্ধি : আত্মার মুনজিয়াত গুণাবলী
(ইখলাছ, তাওয়াক্কুল, সবর, শোকর.... ইত্যাদি) অর্জন এবং মুহলিকাত ত্র“টিসমুহ (রিয়া, কেবর, হাসাদ.... ইত্যাদি) বর্জনের মাধ্যমে অন্তকরণ পরিশুদ্ধির
জন্য সাধনা করতে হবে।
৪) জাসাদের পরিশুদ্ধি : অজু, গোসল ও তাইমুম দ্বারা বাহ্যিক পবিত্রতা অর্জিত হয়। হালাল রিজিক দ্বারা রক্ত-মাংস পবিত্র হয়। নিষিদ্ধ ও বেহুদা চিন্তা-কথা-কাজ পরিহার, চোখ-জিহ্বা-লজ্জাস্থানের হিফাজত, বেশী কাঁদা, কম হাসা, কম কথা বলা, কম খাওয়া, কম ঘুমানো -এর মাধ্যমে জাসাদ পরিশুদ্ধ হবে।
৫) লিবাসের পরিশুদ্ধি : লিবাস হতে হবে পবিত্র, পরিচ্ছন্ন, হালাল পথে অর্জিত, শালীন এবং রসূলুল্লাহ্
সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ছুন্নাহ মোতাবেক তাকওয়ার লিবাস। তাকওয়ার লিবাস গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার
সহায়ক।
আবার মানব সত্তার ব্যক্তি জীবনের পাঁচটি ক্ষেত্র রয়েছে। সুতরাং
তাযকিয়া বা পরিশুদ্ধি জন্য এই পাঁচ ক্ষেত্রেই তাযকিয়া বা পরিশুদ্ধি অর্জন করতে হবে, যথা-
১) ঈমান ও আকিদার পরিশুদ্ধি : ঈমান হতে হবে- র্শিকমুক্ত, কুফরমুক্ত, নিফাকমুক্ত, জাহিলিয়াতমুক্ত এবং
তাগুতমুক্ত। সাহাবা (রা)-গণের নমুনায় ঈমান ও আকিদা
পোষণ করতে হবে। সর্বদা এর উপর অবিচল থাকতে হবে।
২) ইলমের পরিশুদ্ধি : ইলম হতে হবে-সব ধরনের
কুসংস্কার ও বিভ্রান্তিমুক্ত। কুরআন, হাদীস এবং হক্কানী ওলামাদের
লিখিত কিতাব, তাদের মূল্যবান নছিহত ও সোহবাতের মাধ্যমে জাহিরী ও বাতিনী
ইলমের পরিশুদ্ধি করতে হক্ষে।
৩) আমলের পরিশুদ্ধি : আমল হতে হবে- কেবলমাত্র
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আল্লাহর হুকুম ও রসুলুল্লাহ
(স) এর তরিকা অনুযায়ী। রিয়া, কিব্র, জাহিলিয়াত ও বিদআতমুক্ত। সাহাবা (রা)-গণের নমুনায় আমলকে পরিশুদ্ধ করতে হবে।
৪) আখলাকের পরিশুদ্ধি : মুয়ামিলাত ও আখলাক হতে হবে এমন,
যা আল্লাহর দরবারে পছন্দনীয়, রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শে, সাহাবা (রা)-গণের নমুনায়, মানব জাতির জন্য উত্তম শিণীয়
আদর্শ হবে।
৫) অর্থনৈতিক পরিশুদ্ধি : আয়-রোজগার এবং ব্যয় হতে হবে
আল্লাহর দরবারে পছন্দনীয় হালাল পথে। হারাম ও সন্দেহযুক্ত পন্থা সর্বদা বর্জন করতে হবে। এছাড়া আল্লাহর মহব্বততো দুরের কথা, কোন ইবাদাত কবুল হবে না।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে কলবুন সালীম অর্জনের
তৌফিক দান করুন! তাঁর দ্বীনের খেদমতের জন্য কবুল করুন! রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবা (রা)-গনের আদর্শের উপর সর্বদা কায়েম রাখুন! এবং
তাঁদের বরকতময় জামাআতের সংগে আমাদের হাশর করুন! আ-মী-ন।
মাশাআল্লাহ
ReplyDelete