দারস বা মক্তব ভিত্তিক ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্ তা'য়ালার জন্য যিনি
রব্বুল আ'লামীন। দুরূদ ও সালাম রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি, তাঁর পরিবারবর্গ
, সাহাবায়ে কিরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ও সালিহীনগণের (র) প্রতি। আল্লাহ্ তা'য়ালা মানব জাতিকে দুনিয়ার বুকে তাঁর খলিফা বা
প্রতিনিধি হিসাবে কেবলমাত্র তাঁরই ইবাদাতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। মানব জাতির হিদায়াতের জন্য তিনি
যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রসূল (আ) প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেন :
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِيْ كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُوْلاً أَنِ اعْبُدُواْ اللّهَ وَاجْتَنِبُواْ الطَّاغُوْتَ
-নিশ্চয়ই আমি প্রত্যেক
জাতির নিকট এ মর্মে রসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা একমাত্র আল্লাহর
ইবাদাত কর এবং তাগুতকে অস্বীকার কর। (নাহল : ৩৬)
নবী-রসূলগণের (আ) আগমনের ধারাবাহিকতার শেষ প্রান্তে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য আগমন
করেন হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যার আগমন সম্পর্কে সমস্ত নবীগণ (আ) নিজ নিজ জাতিকে অবহিত করেছেন
এবং তাঁর অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। স্থান, কাল, গোত্র, বর্ণ ও ভাষা নির্বিশেষে কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র জনপদের জন্য তিনিই সর্বশেষ ও
একমাত্র নবী। আল্লাহ্ তা'য়ালা বলেন :
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِّلنَّاسِ بَشِيْرًا وَّنَذِيْرًا وَّلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُوْنَ
- আমি আপনাকে বিশ্ববাসী
সব মানুষের জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী করে প্রেরণ করেছি, অথচ
অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। (সূরা সাবা : ২৮)
নবুয়তী ছিলছিলা সমাপ্তির কারণে সে মহান দায়িত্ব উম্মাতে মুহাম্মাদীর উপর অর্পিত
হয়েছে। এ প্রসংগে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন ঘোষণা করেন:
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُوْنَ بِاللّهِ
- তোমরাই সর্বশ্রেষ্ঠ
উম্মাহ, সমগ্র মানব জাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের অভ্যুত্থান,
তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ
করবে এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাসী থাকবে (সূরা আলে ইমরান : ১১০)।
মানব জাতির হিদায়াতের জন্য নবুওয়াতের প্রথম যুগে রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম হযরত আরকাম (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-এর ঘরে তা'লীমুল কুরআন দারস বা মক্তব কায়েম করে নবুওয়াতের
দায়িত্বসমূহ পালন করেছেন। তাঁর এ মক্তব শুধু তাজবীদ নয়, বরং পরিপূর্ণ দ্বীন শিক্ষা তথা নবুওয়াতী কার্যক্রমের অন্যতম কেন্দ্র
ছিল।
মদীনায় হিজরতের পর ইসলাম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে কায়েম হওয়ার পরও মাসজিদে নববীতে
রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মক্তব ভিত্তিক নবুওয়াতী দায়িত্বের কার্যক্রমসমূহ
জারী ছিল। এর নিয়মিত ছাত্র ছিলেন আহলে সুফ্ফা ও মদীনার অধিবাসীগণ এবং অনিয়মিত
ছাত্র ছিলেন দুর-দুরান্তের অন্যান্য সাহাবাগণ। নামাজবাদ এবং জুম'য়ার খুতবার মাধ্যমে সেখানে নিয়মিত সার্বক্ষণিক
পূর্ণাংগ দ্বীনি তা’লীম, তারবিয়াত ও নসীহত
জারী ছিল।
রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নবুওয়াতী দায়িত্ব পালনে এই মক্তব
ভিত্তিক ইসলামী আন্দোলন এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, স্বয়ং আল্লাহ্ তা'য়ালা জিহাদের মত রাষ্ট্রীয়
গুরুত্বপূর্ণ কাজের ক্ষেেত্রও সবাই এক সংগে বেরিয়ে না পড়ে প্রত্যেক কওমের কিছু সংখ্যক
গুণীজনকে রসূলের মক্তবে কওমের মুয়াল্লিম হিসাবে প্রশিক্ষণ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসংগে মহান আল্লাহ্
রাব্বুল ‘আলামীন ঘোষণা করেন:
فَلَوْلاَ نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَآئِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُواْ فِي الدِّيْنِ وَلِيُنْذِرُواْ قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُواْ إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُوْنَ
- তাদের
প্রত্যেক বড় দল থেকে একটি অংশ কেন বের হয় না, যারা দ্বীনের
জ্ঞান অর্জন করবে এবং নিজ নিজ কওমের কাছে ফিরে গিয়ে তাদেরকে ভয় প্রদর্শন করবে,
যাতে তারা বাঁচতে পারে। (সূরা তওবা : ১২২)
নবুওয়াতের জামানায় বিভিন্ন অঞ্চলে রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
এর প্রেরিত প্রতিনিধিগণও স্বীয় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কওমের হিদায়াতের জন্য
নবুওয়াতের নমুনায় দারস বা মক্তব ভিত্তিক দাওয়াত, তা’লীম ও তাযকিয়াসহ ইসলামী আন্দোলনের
যাবতীয় কার্যক্রমসমূহ পরিচালনা করেছেন।
খুলাফায়ে রাশিদীনের জামানায় খলিফার প্রতিনিধিগণ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের সাথে
সাথে মাসজিদ কেন্দ্রিক দ্বীনি দারস বা মক্তব কায়েম করে নবুওয়াতের নমুনায় দায়িত্ব
পালন করেছেন। পরবর্তী কালে রাজতন্ত্রের যুগেও গুরুত্বপূর্ণ সাহাবাগণ
(রাদিয়াল্লাহু আনহু) প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে দুরে থেকে উম্মাহর হিফাজতের জন্য
মাসজিদ বা নিজ বাড়ীতে দারস বা মক্তব কায়েম করে তা'লীম জারী রেখেছেন।
রাজতন্ত্রের জামানায় সাহাবাগণের যুগে হযরত আবূ হুরায়রা, হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা, হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে ওমর, হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে
আব্বাস, হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ, হযরত
আনাস ইবনে মালিক ও হযরত আবূ সাইদ খুদরী ও হযরত হাসান ইবনে আলী (রাদিয়াল্লাহু
আনহু) প্রমুখ অগ্রগণ্য। তাদের দারস বা মক্তবে ছিল নবুওয়াতের নমুনায় কুরআন ও সহীহ্
হাদীস ভিত্তিক দ্বীনের তা’লীম ও গবেষণা।
তাবিঈন ও তাবে-তাবিঈনগণের যুগে উম্মাহর ইমাম ও আহলে বায়েতগণ (র) সাহাবা
(রা)-গণের পদাংক অনুসরণ করে মাসজিদে বা নিজ বাড়িতে দ্বীনি দারস বা মক্তব কায়েম
করেছেন। তাদের মক্তবে ছিল কুরআন, হাদীস ও সাহাবা (রা)-গণের
ফতোয়ার ভিত্তিতে দ্বীনের তা’লীম ও গবেষণা। তারা ইসলামী আইন ও বিধি-বিধান
শ্রেণীবদ্ধ করে ভবিষ্যত উম্মাহর জন্য দিক-নির্দেশনা রেখে গেছেন।
তাবিঈন ও তাবে-তাবিঈনদের যুগে হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব, হযরত উরওয়া ইবনে যুবাইর, হযরত সালেম ইবনে আব্দুল্লাহ্ ইবনে ওমর, হযরত নাফে’,
হযরত হাসান বসরী, ইমাম যুহরী, ইমাম সুফিয়ান সওরী, ইমাম আওযাঈ, ইমাম আবূ হানিফা, ইমাম হাম্মাদ, ইমাম আব্দুল্লাহ্ ইবনুল মোবারক, ইমাম মালেক, ইমাম আহমাদ, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম
মুহাম্মাদ, ইমাম ইউসুফ এবং আহলে বাইতের ইমামগণ (র) অগ্রণী
ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের দারস বা মক্তব ভিত্তিক দ্বীনি কার্যক্রম ছিল তৎকালীন
ও অনাগত ভবিষ্যতের সমগ্র উম্মাহর জীবনের সমস্ত দিক ও ক্ষেেত্রর জন্য অমূল্য পাথেয়।
তাবে-তাবিঈনগণের জামানার পর থেকে আব্বাসীয়, তুর্কী ও ভারতের বাদশাহী আমলে উম্মাহর ঈমান ও আমলের হিফাজতের
জন্য আলিমগণও নবুওয়াতের নমুনায় সাহাবা (রা), তাবিঈন ও
তাবে-তাবিঈন (র)-গণের পদাংক অনুসরণ করে দারস বা মক্তব ভিত্তিক দ্বীনি কার্যক্রম
পরিচালনা করেছেন এবং হিদায়াতের আলো ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার জন্য আজীবন সাধনা করেছেন। তারাও ভবিষ্যত উম্মাহর জন্য
দ্বীনি কার্যক্রম পরিচালনার দিক-নির্দেশনা রেখে গেছেন।
তুর্কী খিলাফত বিলুপ্তির আগ পর্যন্ত দারস বা মক্তব ভিত্তিক ইসলামী আন্দোলন
বিশ্বজুড়ে বিকাশ লাভ করে। এসব দারস বা মক্তবসমূহ বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে
পরিণত হয়। এ যুগে মুসলমানদের ঈমান-আকিদা, আমল-আখলাক, জীবন-দর্শন
ও জীবন ব্যবস্থার মধ্যে নানা ধরণের ভেজালের অনুপ্রবেশ ঘটে, যা
তৎকালীন ওলামা ও গবেষকগণ সুক্ষ্ম গবেষণা ও দক্ষতার মাধ্যমে চিহ্নিত করে হিদায়াতের
সঠিক আলো মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন।
ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম,
ইমাম তিরমিযী, ইমাম আবূ দাউদ, ইমাম নাসাঈ, ইমাম ইবনে মাজাহ্, ইমাম তাহাবী, ইমাম হাকেম নিশাপুরী, ইমাম নববী, ইমাম ইবনে তাইমিয়া, হাফিজ ইবনুল কাইয়্যিম, হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী,
হাফিজ আন্দালুসী, শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিস
দিহলবী, শায়খ শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ ইমাম গাযযালী, শায়েখ আব্দুল কাদের জিলানী, শায়েখ মঈনুদ্দিন চিশতী,
শায়েখ বাহাউদ্দিন নকশবন্দী ও শায়েখ আহম্মাদ ছিরহিন্দী (র) প্রমুখ সে
যুগে নবুওয়াতের নমুনায় দারস বা মক্তব ভিত্তিক দ্বীনি কার্যক্রমের অগ্রপথিক ছিলেন।
বিংশ শতাব্দীতে তুর্কী খিলাফতের বিলুপ্তির পর সারা বিশ্বে ইংরেজদের আধিপত্য
প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম জীবন ও সভ্যতা থেকে কুরআন ও ছুন্নাহকে বিলুপ্ত করার
জন্য তারা ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ইসলামী প্রতিষ্ঠান সমূহ ধংস করে দেয় এবং সম্মানিত আলিমগণকে
হত্যা করে। সর্বত্র নগ্নতা, অশ্লীলতা ও
বেহায়াপনা ছড়িয়ে দিয়ে ঈমান-আকিদা, আমল-আখলাক, মুয়ামিলাত ও নৈতিক মূল্যবোধ বিনষ্ট করার অপপ্রয়াস চালায়। এহেন দুরাবস্থায় তাদের
জুলুম-নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাওয়া আলিমগণ মহল্লায় মহল্লায় দরিদ্র মুসলমানদের সামর্থ্য
মোতাবেক সাহায্য ও মুষ্টি চালে ছোট ছোট মক্তব ভিত্তিক দ্বীনি কার্যক্রমের কেন্দ্র
কায়েম করে মুসলিম উম্মাহর ঈমান ও আমল হিফাজতের জন্য আজীবন সাধনা করেছেন। মুসলিম জনগণ, পরিবার ও সমাজের সাথে এ সব মক্তবের ছিল
সুগভীর সম্পর্ক।
এ সব মক্তব ভিত্তিক ইসলামী আন্দোলনের মাঝে নবুয়তের নমুনায় দাওয়াত ও তাবলীগ, তা'লীম ও তারবিয়াত,
তাযকিয়া বা পরিশুদ্ধি, পারিবারিক ও সামাজিক কল্যাণ
ও জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ্ কার্যক্রমসমূহ একই সাথে জারী রাখার জন্য আপ্রাণ সাধনা করা
হয়। ভারতবর্ষের দেওবন্দ আন্দোলন নবুওয়াতের নমুনায় তৎকালীন দারস
বা মক্তব ভিত্তিক ইসলামী আন্দোলনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পরবর্তীকালে দেওবন্দ
থেকে সনদ নেয়া ওলামাগণ যুগে যুগে দারস বা মক্তব ভিত্তিক ইসলামী
আন্দোলনের এ পথেই অগ্রসর হয়েছেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে মুসলিম উম্মাহর মাঝে
নবুওয়াতের নমুনায় মক্তব ভিত্তিক ইসলামী আন্দোলনের কার্যক্রমসমুহ মক্তব থেকে
আংশিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং বিভিন্ন ফিরকায় বিভক্ত হয়ে আংশিক কার্যক্রম নিয়ে
বিভিন্ন স্রোতধারা সৃষ্টি হয়। ফলে মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিভিন্ন দলের উদ্ভব হয়। ফলে উম্মাহর শক্তি
খণ্ড-বিখণ্ড ও দুর্বল হয়ে যায়।
এ হল মক্তব ভিত্তিক ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস। মুসলিম দেশসমূহ স্বাধীন হলেও
কুরআন ও ছুন্নাহ বিরোধী বিজাতীয় অপতৎপরতায় উম্মাহ আজও বিপর্যস্ত, দিশেহারা ও হতাশাগ্রস্ত। মুসলিম উম্মাহর এহেন
দুরাবস্থায় রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওয়ারিস হিসাবে সমস্ত
হক্কানী ওলামা, ইমাম,
মুয়াল্লিম, মুবাল্লিগ ও নিষ্ঠাবান মুসলিমগণকে
নবুওয়াতের নমুনায় সাহাবা (রা), তাবিঈন ও তাবে-তাবিঈন
(র)-গণের অনুসৃত পন্থায় মক্তব ভিত্তিক ইসলামী আন্দোলনের জন্য অবশ্যই সমস্ত মাসজিদে
মাসজিদে মহল্লায়-মহল্লায় তা'লীমুল কুরআন মক্তব গড়ে তুলতে হবে। দল-মত নির্বিশেষে সমগ্র
মহল্লাবাসীকে এর সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে।
মুসলিম উম্মাহর সার্বিক কল্যাণ, সমৃদ্ধি,
সম্মান, ও মর্যাদার জন্য কুরআনের সাথে
সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন যাবতীয় মর্যাদা ও সম্মান কুরআনের সাথে সংযুক্ত করেছেন। যেমন-সর্বশ্রেষ্ঠ রাত হল
লাইলাতুল ক্বদর, কারণ এ রাতে
কুরআন অবতীর্ন হয়েছে। সর্বশ্রেষ্ঠ মাস হল রমজান মাস, কারণ এ মাসে কুরআন অবতীর্ন হয়েছে। সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদাত হল সালাত, কারণ এ সালাতের মাঝে কুরআন তিলাওয়াত করা হয়। সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হল ঐ
ব্যক্তি, যে নিজে কুরআন শিখে ও
অন্যকে শিখায়। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হলেন ঐ নবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম) যে নবীর উপর এই কুরআন নাজিল হয়েছে। সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মাহ হল ঐ
উম্মাহ, যাদের প্রতি কুরআন
অবতীর্ন হয়েছে। সুতরাং মুসলিম উম্মাহর সে হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে হলে
কুরআন ও ছুন্নাহ মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে আর মক্তব ভিত্তিক ইসলামী আন্দোলনের
মাধ্যমে আদর্শ ব্যক্তি, পরিবার,
সমাজ, জাতি ও উম্মাহ গড়ে তুলতে হবে।
কুরআন নাজিল করা হয়েছে সমগ্র মানব জাতির হিদায়াতের জন্য তথা জীবনের সার্বিক
দিক বিকশিত করার মাধ্যমে মানব জাতির ইহ-পরলৌকিক যাবতীয় কল্যাণ ও সমৃদ্ধির জন্য। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের
বিষয়! বর্তমানে মুসলিম উম্মাহর সাথে পবিত্র কুরআনের সম্পর্ক এতই শোচনীয় যে, সার্বিক জীবন গঠন করাতো দূরের কথা, কুরআনে আল্লাহ তা'য়ালা কি বলেছেন অধিকাংশ মুসলিম তা
জানেন না, এমন কি বিশুদ্ধ তিলাওয়াত করতেও পারেন না। এহেন দুরাবস্থায় পবিত্র
কুরআনকে সম্মিলিতভাবে আঁকড়ে ধরে সর্বশ্রেষ্ঠ রাত, সর্বশ্রেষ্ঠ মাস এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদাতের ন্যায় মুসলিম উম্মাহ
আবার সমগ্র বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হতে পারে।
কুরআনের মক্তবের ফজিলত : হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি দ্বীনি ইলম অর্জনের উদ্দেশ্যে কোন পথ
অবলম্বন করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেন। কোন একদল লোক যখন আল্লাহ তা'য়ালার ঘর সমূহের মধ্যে কোথাও একত্র হয়ে
আল্লাহর কিতাব পাঠ এবং পরস্পর আলোচনা করতে থাকে তখন তাদের উপর সাকিনা অবতীর্ণ হতে
থাকে, রহমত ও অনুগ্রহ তাদেরকে ঢেকে দেয়, ফিরিশতাগণ তাদেরকে বেষ্টন করে নেন এবং আল্লাহ তাঁর নিকটবর্তী ফিরিশতাদের
সামনে তাদের উল্লেখ করে থাকেন। (সহীহ্ মুসলিম)
মনে রাখবেন! মক্তব শুধুমাত্র তাজবীদ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান নয়, বরং পরিপূর্ণ দ্বীনি শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান। দারস বা মক্তব ভিত্তিক ইসলামী
আন্দোলনই নবুওয়াতের নমুনায় সাহাবা (রা), তাবিঈন,
তাবে-তাবিঈন ও ওলামাগণের (র) অনুসৃত পন্থা। তাদের পদাংক অনুসরণ করে
মক্তবের বুনিয়াদী কাজ হল-
(১) কুরআন
শিক্ষা : তাজবীদসহ সহীহ তিলাওয়াত, অর্থ ও ব্যাখ্যা শিক্ষা। কুরআন ও ছুন্নাহ অনুযায়ী
জীবনের সার্বিক দিক গঠনের বাস্তব তা'লীম। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও
জাতীয় জীবনের পরিশুদ্ধির তা’লীম ।
(২) উম্মাহর
উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন : দাওয়াত ও তাবলীগ, তা'লীম ও তারবিয়াত, তায্কিয়া বা পরিশুদ্ধি, পারিবারিক ও সামাজিক কল্যাণ এবং বিশ্ব মানবতার কল্যাণ কার্যক্রমসমূহ সফল
বাস্তবায়নের মাধ্যমে মদীনাতুন্নবী (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নমুনায়
আদর্শ সমাজ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় বাস্তব প্রশিক্ষণ।
আমাদের দায়িত্ব : আমরা সবাই আল-কুরআনের ছাত্র হব। আজীবনের জন্য আল-কুরআনের
ছাত্র হব। মাসজিদে-মাসজিদে মহল্লায়-মহল্লায় আল-কুরআনের মক্তব গড়ব। মক্তবে আমরা
সহীহ তিলাওয়াতসহ পরিপূর্ণ দ্বীন শিখব। সাহাবাদের ন্যায় জীবন গড়ার কৌশল শিখব।
কুরআনের আলো ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করব। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তার দ্বীনের
খেদমতের জন্য কবুল করুন! রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবা
(রা)-গনের আদর্শের উপর সর্বদা কায়েম রাখুন! এবং তাঁদের বরকতময় জামাআতের সংগে
আমাদের হাশর করুন! আ-মী-ন।
আমরা সবাই আল-কুরআনের ছাত্র হব। আজীবনের জন্য আল-কুরআনের ছাত্র হব।
ReplyDelete