পরকালে রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম-এর সাথী যারা
ডাঃ গাজী মোঃ নজরুল ইসলাম
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা'য়ালার জন্য যিনি রব্বুল আলামীন। দুরুদ ও সালাম রসূলুল্লাহ্ সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি যিনি
রহমাতুল্লিল আলামীন, তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কিরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) এবং সালেহীন (র)-গণের প্রতি। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই। আমরা আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (স)
তাঁর বান্দাহ ও রসূল। নিশ্চয়ই শুভ
পরিণতি শুধুমাত্র মুত্তাকীনদের জন্য নির্ধারিত।
আল্লাহ তা'য়ালা
ও তাঁর রসুলের হুকুম মান্যকারী আল্লাহ তা'য়ালার
অনুগ্রহপ্রাপ্ত বান্দাগণই পরকালে রসূলুল্লাহ্
সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে জান্নাতে অবস্থানের সৌভাগ্য অর্জন করবেন। এ
প্রসংগে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন :
وَمَنْ يُطِعِ
اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ
مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ
أُولَئِكَ رَفِيقًا ০
-আর
যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রসুলের হুকুম মান্য করবে, সে তাদের সংগী
হবে- যাদের প্রতি আল্লাহ নিয়ামত দান করেছেন, তারা হলেন- নবীগণ,
সিদ্দিকগণ, শহীদগণ ও সলেহীনগণ আর তাদের সান্নিধ্যই
হল উত্তম। -(সূরা নিছা : ৬৯)
উক্ত
আয়াত মোতাবেক সিদ্দিকগণ হলেন নবী-রসূল (আলাইহিসসালাম)-গণের সবচেয়ে নিকটবর্তী
সৌভাগ্যময় মানুষ, যাদেরকে আল্লাহ তা'য়ালা নবী-রসূল
(আলাইহিসসালাম)-গণের অবর্তমানে মানব জাতিকে সঠিক পথ-প্রদর্শনের জন্য মনোনীত
করেছেন। এর মধ্যে সিদ্দিকে আকবার হলেন হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু
আনহু। আর আল্লাহ তা'য়ালা
বিশ্বাসী বান্দাগণকে সঠিক পথের সন্ধান লাভের জন্য সিদ্দিকগনের সংগী হওয়ার নির্দেশ
দিয়েছেন। এ প্রসংগে তিনি বলেন :
يَا أَيُّهَا
الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ ০
অর্থাৎ-
হে ঈমানদার বান্দাগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করে চল এবং (তাকওয়া অর্জনের লক্ষ্যে) সদিকীনগণের
সংগী হও। (সূরা তওবা : ১১৯)
পরকালে যারা রসূলুল্লাহ্ সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নৈকট্য অর্জন করবেন,
তাঁর সংগী হবেন এবং যারা তাঁর সাথে জান্নাত লাভের সৌভাগ্য অর্জন করবেন তাদের
প্রসংগে হাদীস গ্রন্থসমূহে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এর ভিতর থেকে কয়েকটি বাছাইকৃত
হাদীস সকলের বিবেচনা ও আমলের জন্য পেশ করা হল।
যারা আল্লাহর
রাসূলকে ভালবাসেঃ হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। এক
সাহাবী আবেদন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! ক্বিয়ামত কখন হবে?
উত্তরে আল্লাহর রাসূল জিজ্ঞেস করলেন, ক্বিয়ামতের
জন্য তুমি কী প্রস্তুতি নিয়েছ? সাহাবীটি আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! তজ্জন্য আমি তেমন কোন প্রস্তুতি নিতে পারিনি; তবে আমি আমার আল্লাহ্ ও আল্লাহর রাসূলকে ভালবাসি । রাসুলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ "তুমি যাকে ভালবাস ক্বিয়ামত দিবসে
তুমি তার সাথে থাকবে"। হযরত আনাস রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেনঃ
"ইসলামের আবির্ভার পরে আমি মুসলমানদেরকে এরূপ খুশি হতে দেখিনি, যেরূপ একথা গুলো শুনে খুশি হয়েছেন"।
-(বুখারী শরীফঃ ২য় খন্ডের ৯১১ পৃষ্ঠা, মুসলিম শরীফঃ
২য় খন্ডের ৩৩১ পৃষ্ঠা)
একই বিষয়েঃ হযরত ইবনে মাসঊদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে
এসে বলল, হে আলাহর রসূল! এক ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়কে ভালবাসে
কিন্তু তাদের সাথে মিলিত হতে পারছে না, এ ব্যক্তি সম্পর্কে
আপনি কি বলেন ? রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
বললেন : যে ব্যক্তি যাকে ভালবাসে (হাশরের ময়দানে ও জান্নাতে) সে তার সাথেই থাকবে।
- (বুখারী ও মুসলিম)
ভালবাসার মর্মঃ হযরত আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে
বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : সেই আল্লাহর শপথ
যার হাতে আমার প্রাণ! তোমাদের কেউ প্রকৃত মু'মিন হতে পারবে না,যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা ও
সন্তানাদির চেয়ে অধিক ভালবাসার পাত্র হই। - (সহীহ বুখারী : হাদীস নং-১৪)
অপর বর্ণনায় রয়েছেঃ হযরত আনাস ইবন
মালিক (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : তোমাদের কেউ
প্রকৃত মু'মিন হতে পারবে না,যতক্ষণ
না আমি তার নিকট তার পিতা,তার সন্তান ও সব মানুষের অপেক্ষা
অধিক প্রিয়পাত্র হই । - (সহীহ বুখারী :
হাদীস নং-১৫)
যারা রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাত জিন্দাকারীঃ হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু
আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যে আমার কোন সুন্নাত জিন্দা করল সে যেন আমাকে জিন্দা করল। আর যে আমাকে
জিন্দা করল সে আমার সাথে জান্নাতে যাবে। -(তিরমিজীঃ ২য় খন্ড,
পৃষ্ঠা-৯৬)
অপর বর্ণনায় রয়েছেঃ হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু‘আনহু
থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে
বলেছেনঃ ‘বেটা! সকাল-সন্ধ্যায় যদি এমনভাবে থাকতে পার
যে, তোমার মনে কারো প্রতি বিদ্বেষ নেই তাহলে এমনভাবেই থাক।
বেটা! এটি আমার সুন্নত। যে আমার সুন্নতকে যিন্দা করে সে আমাকে ভালবাসে। আর যে
আমাকে ভালবাসে সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে।’ -{জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৬৭৮}
সুন্নাতের অর্থ হল রসূলুল্লাহ্
সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবাগণের আদর্শঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর
(রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্র্ণিত। রসূলুল্লাহ্
সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : বানী-ইসরাইলীগণ বাহাত্তর দলে বিভক্ত
হয়েছিল আর আমার উম্মাত বিভক্ত হবে তিয়াত্তর দলে, সকলেই জাহান্নামে যাবে, কিন্তু একটি মাত্র দল জান্নাতে
যাবে। সাহাবাগণ (রা) জিজ্ঞাসা করলেন- এই দল কারা? রসূলুলাহ
(সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন : যারা আমার ও আমার সাহাবাগণের সুন্নাতের
উপর কায়েম থাকবে। - (তিরমিযীঃ ২৫৭৮, আবু দাউদ, তারগীবঃ ৪৮)
সুন্নাত জিন্দা করার অর্থঃ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : দ্বীন ইসলাম তো অপরিচিত অবস্থায় যাত্রা শুরু করেছিল এবং অচিরেই অপরিচিত অবস্থায় ফিরে আসবে।
সুতরাং সুসংবাদ সেই অপরিচিতদের জন্য -(তিরমিযীঃ ২৫৬৬) তাদের পরিচয় প্রসংগে বলা হয়েছে- যারা আমার ছুন্নাহ মানুষের দ্বারা বিপর্যস্থ হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় ইসলাহ বা পূণর্র্জীবিত করে। -(তিরমিজীঃ ২৫৬৭)
যারা
সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারীঃ হযরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে
বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : তোমাদের মধ্যে আমার অতি প্রিয় ও কিয়ামতের দিন আমার অতি নিকটে আসন
গ্রহণকারী সে, যে তোমাদের মধ্যে অধিক সুন্দর চরিত্রের
অধিকারী। -[মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ]
একই
বিষয়েঃ হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি নৈতিক দিক
দিয়ে সর্বোত্তম, সেই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় এবং কিয়ামতের
দিন সে সর্বাপেক্ষা আমার নিকটতম হবে। আর তোমাদের মধ্যে যেসব লোক বাচাল, দুর্বোধ্য ভাষায় এবং অহংকারের সাথে কথা বলে তাঁরা আমার কাছে সর্বাধিক
ঘৃণিত এবং কিয়ামতের দিন আমার কাছ থেকে অনেক দূরে থাকবে। -[তিরমিযী]
ওযুর পর
দুই রাকাআত নফল সালাত (তাহিয়্যাতুল ওযু) রীতিমত আদায়কারীঃ হযরত
আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন ফজরের নামাযের
পর বেলাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে জিজ্ঞেস করলেন, হে বেলাল! ইসলাম গ্রহণের পর তোমার এমন কি আমল আছে যার বিনিময়ে তুমি
পুরস্কৃত হওয়ার আশা রাখ? কেননা আজ রাতে আমি জান্নাতে আমার
সামনে তোমার চলার শব্দ পেয়েছি। বেলাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু
বললেন : আমি এর চেয়ে অধিক কোন আমল তো দেখছি না যে, দিনে বা
রাতে যখনই আমি ওযু করি তখনই যতটুকু আল্লাহ তাওফিক দেন ততটুকু নফল সালাত আমি আদায়
করি। -[বুখারি ও মুসলিম]
রসূলুল্লাহ-এর প্রতি
বেশী বেশী দুরূদ পাঠকারীঃ হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত
। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন : “কিয়ামতের
দিন ঐ ব্যক্তিই সর্বাপেক্ষা আমার নিকটবর্তী হবে, যে আমার
প্রতি সবচেয়ে বেশি দরূদ পাঠ করেছে" । -[সুনানে তিরমিযী, হাদিস নং-৪৮৪]
দুই বা
দুইয়ের অধিক কন্যা সন্তানকে লালন-পালন কারীঃ হযরত আনাস ইবন
মালেক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি
বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি দুইজন
কন্যাকে তাদের প্রাপ্তবয়স্কা হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করল, কিয়ামতের
দিন আমি ও ঐ ব্যক্তি এক সাথে উপস্থিত হব। একথা বলে তিনি তাঁর দুই আঙ্গুলকে একত্রিত
করে দেখালেন। -[মুসলিম, হাদীস নং ২৬৩১]
ইয়াতীমের
লালন-পালনকারীঃ হযরত আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু
থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ইয়াতীমের লালন পালনকারী-ইয়াতীম তার আত্মীয় হোক আর
অনাত্মীয়- ও আমি জান্নাতে এ দুই আঙ্গুলের ন্যায় এ বলে তিনি তাঁর দুই আঙ্গুলকে
একত্রিত করে দেখালেন যে এভাবে এক সাথে থাকব। (হাদিসের বর্ণনাকারী) ইমাম মালেক
(রহঃ) শাহাদাত ও মধ্যমাঙ্গুলির প্রতি ইশারা করে দেখিয়েছেন। -[মুসলিম, জুহুদ অধ্যায়]
আল্লাহ
তা’য়ালা আমাদের সবাইকে তাঁর দ্বীনের খেদমতের জন্য কবুল করুন!
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবা (রাদিয়াল্লাহুম)-গনের
আদর্শের উপর সর্বদা কায়েম রাখুন! তাঁদের বরকতময় জামাআতের সংগে আমাদের হাশর করুন!
আর রসূলুল্লাহ্ সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে জান্নাত লাভের তৌফিক দান
করুন! আ-মী-ন।
আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সবাইকে তাঁর দ্বীনের খেদমতের জন্য কবুল করুন! রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবা (রাদিয়াল্লাহুম)-গনের আদর্শের উপর সর্বদা কায়েম রাখুন! তাঁদের বরকতময় জামাআতের সংগে আমাদের হাশর করুন! আর রসূলুল্লাহ্ সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে জান্নাত লাভের তৌফিক দান করুন! আ-মী-ন।
ReplyDelete