Thursday, April 2, 2015

আল্লাহ তা’য়ালার ইবাদাতঃ পর্ব-১০


আল্লাহ তায়ালার ইবাদাত হতে হবে তাগুতমুক্ত
ডাঃ গাজী মোঃ নজরুল ইসলাম

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি রব্বুল আলামীন। দুরুদ ও সালাম রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি,তার পরিবারবর্গ,বংশধর,সাহাবায়ে কিরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) ও সালেহীণ (রহমাতুল্লাহি আলাইহিম)-গণের প্রতি। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই এবং মুহাম্মাদ (স) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রসূল। নিশ্চয়ই শুভ পরিণতি কেবলমাত্র রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, খুলাফায়ে রাশিদীনে এবং সাহাবা (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-গণের অনুসৃত কল্যাণময় আদর্শ অনুসরণের মধ্যেই নিহিত।

আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম আলাইহিসসালাম-কে দুনিয়ায় প্রেরণে পর থেকে হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত যুগে যুগে মানব জাতির মাঝে অসংখ্য নবী-রসূল (আ) হিদায়াতসহ প্রেরণ করেছেন। তারা সকল প্রকার আল্লাহদ্রোহী শক্তি বা তাগুতকে অমান্য করে মহান আল্লাহ তায়ালার ইবাদাতের দিকে মানব জাতিকে আহবান করেছেন। এ প্রসংগে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ "নিশ্চয়ই আমি প্রত্যেক উম্মাতের নিকট এ মর্মে রসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত কর এবং তাগুতকে অমান্য কর।"-(সূরা নহলঃ আয়াত ৩৬)

তাগুতকে অস্বীকার করেই আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপনঃ আল্লাহ বলেন : "দ্বীনের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই। সুপথ গোমরাহীর পথ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। অতঃপর যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে এমন এক মজবুত হাতল ধারণ করবে, যা কখনও বিচ্ছিন্ন হবে না। আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও মহাজ্ঞানী।"-(সূরা বাকারাহঃ আয়াত ২৫৬)

তাগুতের দাসত্ব ত্যাগ করেই আল্লাহর ইবাদাতঃ আল্লাহ বলেন : "যারা তাগুতের দাসত্ব থেকে দুরে থাকে এবং আল্লাহর অভিমুখী হয়, তাদের জন্য সুসংবাদ, অতএব আমার বান্দাগণকে সুসংবাদ দিন।"-(সূরা যুমারঃ আয়াত ১৭)

তাগুতের সংজ্ঞাঃ তাগুত হল- ঐ সব কর্তৃত্বশীল শক্তি, যারা আল্লাহ প্রদত্ত হিদায়াত ও নবী-রসূল (আ) প্রদর্শিত আদর্শ সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিত্যাগ করে নিজেদের খেয়াল-খুশী মোতাবেক রসম-রেওয়াজ, আইন-কানুন, বিধি-বিধান, নীতিমালা ও সংবিধান নিজেদের জন্য তৈরী করছে এবং তাদের অধীনস্তদেরকে পরিচালনা করছে। মানব সভ্যতায় বিভিন্ন প্রকার তাগুত রয়েছে যেমন-

ব্যক্তিগত তাগুতঃ মানুষ যখন আল্লাহর হিদায়াত অমান্য করে প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা তথা নাফসে আম্মারার অনুসরণ করে, আল্লাহ তায়ালার হুকুম আর রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শের তোয়াক্কা না করে মনের খেয়াল মোতাবেক জীবন, দেহ ও অধিনস্ত অংগ-প্রত্যংগসমূহ পরিচালনা করে-  তাকে বলা হয় ব্যক্তিগত তাগুত বা নাফসে আম্মারা। ব্যক্তিগত তাগুতের পরকালীন ঠিকানা হবে জাহান্নাম।

আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ "অতঃপর যে সীমালংঘন করে, পৃথিবীর জীবনকে অগ্রাধিকার দেয়, জাহান্নামই হবে তার আবাস। আর যে নিজ প্রতিপালকের সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয়ে প্রকম্পিত হয় এবং নাফসের অনুসরণ হতে নিজেকে বিরত রাখে জান্নাতই হবে তার বাসস্থান।"-(সূরা নাযিয়াতঃ আয়াত ৩৭-৪১)

তিনি আরও বলেনঃ "আর আমি বহু জ্বিন এবং মানুষকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তারা তা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে না, তাদের চোখ আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখার চেষ্টা করে না, তাদের কান আছে, কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনার চেষ্টা করে না। তারা পশুর মত অথবা পশুর চেয়েও বেশি পথভ্রষ্ট। বস্তুত তারাই উদাসীন
- (সূরা আরাফঃ আয়াত ১৭৯)

পারিবারিক তাগুতঃ পরিবার প্রধানের দায়িত্ব হল স্বীয় পরিবার সাহাবাগণের (রা) পরিবারের ন্যায় আদর্শ পরিবার হিসাবে গড়ে তোলা। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ "হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিজন দেরকে সে আগুন থেকে রক্ষা কর, যে আগুনের জ্বালানী হবে মানুষ এবং পাথর, যে আগুনের পাহারাদার হবে নির্মম হৃদয় ও কঠোর স্বভাবের অধিকারী ফেরেশতাগণ। তারা আল্লাহর কোন আদেশের অবাধ্য হন না। বরং তিনি তাদেরকে যে কাজ করার আদেশ করেন, তারা তাই করেন।"- (সূরা তাহরীমঃ আয়াত ৬)

কলুষিত হৃদয়ের কোন পরিবার প্রধান যখন আল্লাহর বিধান ও রসূলের আদর্শ অমান্য করে যথেচ্ছা স্বীয় জীবন এবং অধিনস্ত পরিবারের সদস্যদের জীবন পরিচালনায় বাধ্য করে, তখন তাকে বলা হয় পারিবারিক তাগুত। হাদীসে এই ধরনের পারিবারিক তাগুতকে দাইয়ুস নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

এ প্রসংগে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ "যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান এবং রসূলের দিকে এসো তখন তারা বলে, আমাদের জন্যে তাই যথেষ্ট, যার উপর আমরা আমাদের বাপ--দাদাকে পেয়েছি। যদি তাদের বাপ দাদারা কোন জ্ঞান না রাখে এবং হেদায়েত প্রাপ্ত না হয় তবুও কি তারা তাই করবে?"-(সূরা মায়েদাহঃ আয়াত ১০৪)

সামাজিক তাগুতঃ জনপ্রতিনিধি, জননেতা ও সমাজপতি প্রশাসকগণের দায়িত্ব হল- আল্লাহর বিধান অনুসারে জনগণকে পরিচালনা করা। কিন্তু কুরআন ও ছুন্নাহ লংঘন করে নিজেরাই যখন সেচ্ছাচারের ভিত্তিতে জনগণকে তখন তারা আল্লাহ দরবারে আবু লাহাব ও আবু জাহেল-দের ন্যায় তাগুত হিসাবে গণ্য হয়।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ "আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়সালা করলে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর নিজেদের কোন ব্যাপারে অন্য কোন সিদ্ধান্তের ইখতিয়ার থাকবে না। কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সে তো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে" -(সূরা আহযাবঃ আয়াত ৩৬)

তাদের পরিণাম প্রসংগে তিনি বলেনঃ "যেদিন তাদের মুখমণ্ডল অগ্নি উলট-পালট করে দিবে সেদিন তারা বলবে, হায় আফসোস! আমরা যদি আল্লাহকে মানতাম ও তাঁর রাসুলকে মানতাম! তারা আরও বলবে, হে আমাদের রব! আমরা আমাদের নেতৃবৃন্দ ও বড়দের বড়দের আনুগত্য করেছিলাম এবং তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল, হে আমাদের রব! তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি প্রদান করুন এবং তাদেরকে দিন মহা অভিশম্পাত।" -[সূরা আহযাবঃ আয়াত ৬৬-৬৮]

ভন্ড ধর্মীয় তাগুতঃ ধর্মীয় নেতাগণের দায়িত্ব হল- রসূলের ওয়ারিস হিসাবে আল্লাহর কিতাব ও ছুন্নাহর হিফাজত করা। কিন্তু তাদের মধ্যে কেহ যখন ফতোয়াবাজীর মাধ্যমে হারামকে হালাল আর হালালকে হারাম ঘোষনা করে এবং জনগণ তা মেনে নেয়, তখন তারা তাগুত হিসাবে পরিগণিত হয়। আল্লাহর হুকুম পরিত্যাগ করে পন্ডিত ও নেতাদের হুকুম মানা শিরক। যেমন-

আল্লাহ তায়ালা বলেন : "তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের পণ্ডিতগণ ও সংসার-বিরাগীদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়ামপুত্র মাসীহকেও। অথচ তারা এক ইলাহের ইবাদত করার জন্যই আদিষ্ট হয়েছে, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তারা যে শরীক করে তিনি তা থেকে পবিত্র।" -(সূরা তাওবাঃ আয়াত ৩১)

রাষ্ট্রীয় তাগুতঃ রাষ্ট্রনায়ক, বিধায়ক, বিচারক ও প্রশাসকগণের দায়িত্ব হল- আল্লাহ প্রদত্ত হিদায়াত অনুসারে আইন প্রণয়ন, শাসন পরিচালনা ও বিচার-ফয়সালা করা। কিন্তু কুরআন ও ছুন্নাহ লংঘন করে নিজেরাই যখন আইন, বিধি-বিধান ও নীতিমালা তৈরী করে প্রশাসন পরিচালনা ও বিচার-ফয়সালা করে আর ক্ষমতার জোরে জনগণকে তা মানতে বাধ্য করে তখন তারা আল্লাহ তায়ালার দরবারে নমরূদ ও ফিরআউন-দের ন্যায় তাগুত হিসাবে গণ্য হয়।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ "তারা কি জাহেলী (তাগুতী) আইন ও শাসন চায়? বিশ্বাসী কওমের জন্য আল্লাহর আইন ও শাসনের চেয়ে কার আইন ও শাসন উত্তম হতে পারে?"-(সূরা মায়েদাহঃ আয়াত ৫০)

হযরত কাব বিন উজরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ "জেনে রাখো অচিরেই অনেক জালিম শাসক আসবে। যারা সেই সকল শাসকদের সাথে আঁতাত করবে, তাদের অন্যায়গুলোকে সমর্থন দিবে এবং তাদের জুলুমে সহযোগিতা করবে সে আমার উম্মত নয় এবং আমিও তাঁদের দায়িত্ব নিবো না এবং (কিয়ামতের দিন) তাকে আমার হাউজে কাউসারের সামনে আসতে দেয়া হবে না। আর যাঁরা সেই সকল জালিম শাসকদের সাথে আঁতাত করবে না, তাদের জুলুমে সহায়তা করবে না তাঁরা আমার উম্মত এবং আমি তাঁদের দায়িত্ব নিবো এবং তাঁদেরকেই কিয়ামতের দিন হাউজে কাউসারের পানি পান করানো হবে।" -(তিরমিযীঃ হাদীস নং ৬১৪)

ইবলিসি তাগুতঃ ইবলিস মানুষের অন্তঃকরণকে আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদতের দিকে প্ররোচিত করে। ফলে মানব জাতির মাঝে শুরু হয় সেচ্ছাচারিতা, নাস্তিকতা, পূর্ব পুরুষদের প্রচলিত রসম-রেওয়াজ, মুর্তিপুজা, শক্তিপুজা, জাহিলিয়াত বা মূর্খতা, মানব রচিত তন্ত্র-মন্ত্র ও বিধি-বিধানের অন্ধ অনুসরণ।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ "হে বনী-আদম! আমি কি তোমাদেরকে বলে রাখিনি যে, শয়তানের এবাদত করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? এবং আমার এবাদত কর। এটাই সরল পথ।" -(সুরা ইয়াসিনঃ আয়াত ৬০-৬১)

তাগুতের পরিণামঃ মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন:"যারা আমার আয়াতগুলোকে মিথ্যা মনে করে অস্বীকার করেছে এবং তাগুতের ভূমিকা অবলম্বন করেছে, তাদের জন্য আসমানের দরজা কখনো খোলা হবে না। তাদের জান্নাতে প্রবেশ করা ততোখানি অসম্ভব যতোখানি অসম্ভব সূচের ছিদ্রের ভেতন দিয়ে উষ্ট্র প্রবেশ। অপরাধীদের জন্য প্রতিফলন এমন হওয়াই উচিত। তাদের জন্য আগুনের শয্যা ও চাদর নির্দিষ্ট আছে। আমরা জালেমদেরকে এ ধরণের প্রতিফলনই দিয়ে থাকি।
-(সূরা আরাফঃ আয়াত ৪০-৪১)

আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপনের পর তা ভঙ্গ করে তাগুতী ভুমিকার পরিনামঃ   আল্লাহ বলেন: "আর যারা আল্লাহর অঙ্গীকারকে দৃঢ় ও পাকা-পোক্ত করার পর তা ভঙ্গ করে, আল্লাহ যে সম্পর্ক বজায় রাখতে আদেশ করেছেন, তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে, ওরা ঐ সমস্ত লোক যাদের জন্যে রয়েছে অভিসম্পাত এবং ওদের জন্যে রয়েছে কঠিন আযাব।" -(সূরা রাদঃ আয়াত ৪৭)

স্রষ্টাকে অমান্য করে সৃষ্টিজগতের কারো আনুগত্য নাইঃ হযরত উম্মে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ "স্রষ্টাকে অমান্য করে সৃষ্টিজগতের কারো আনুগত্য চলবে না"-(জামেউল আহাদীসঃ ১৩৪০৫, মুয়াত্তাঃ ১০, মুজামূল কাবীরঃ ৩৮১, মুসনাদে শিহাবঃ ৮৭৩, আবি শাইবাঃ ৩৩৭১৭ ও কানযুল উম্মালঃ ১৪৮৭৫)

হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত।  নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:  "গুনাহের কাজে কোনো আনুগত্য নাই, আনুগত্য শুধু নেক কাজে ব্যাপারে" -(বুখারী ও মুসলিম)

সুতরাং খাঁটি ঈমান ও ইবাদাত হতে হবে সকল প্রকার তাগুত মুক্ত। আল্লাহ তায়ালার ইবাদাত করতে হলে আল্লাহদ্রোহী শক্তি বা তাগুতকে চিনতে হবে সকল প্রকার তাগুককে অমান্য করে সেচ্ছায় আল্লাহ তায়ালার মহান দরবারে নিঃশর্ত আত্মসমর্পন করতে হবে। অন্যথায় তার তাগুত মিশ্রিত কার্যক্রম আল্লাহর দরবারে শিরক হিসাবে গণ্য হবে। আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে এ মহাসত্য অনুধাবন করার তৌফিক দান করুন! আমাদেরকে ইখলাসের সাথে জীবনের সর্বক্ষেত্রে শুধুমাত্র তাঁরই ইবাদাত বা গোলামী করার তৌফিক দান করুন! সকল প্রকার তাগুত থেকে হেফাজত করুন! আ-মী-ন।


No comments:

Post a Comment