Sunday, June 1, 2014

যাকাতের গুরুত্ব ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যাকাত


যাকাতের গুরুত্ব ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যাকাত

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা'য়ালার জন্য যিনি রব্বুল আলামীনদুরুদ ও সালাম রসূলুল্লাহ্ সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি যিনি রহমাতুল্লিল আলামীন, তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কিরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) এবং সালেহীন (র)-গণের প্রতিআমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাইআমরা আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর বান্দাহ ও রসূলনিশ্চয়ই শুভ পরিণতি শুধুমাত্র মুত্তাকীনদের জন্য নির্ধারিত।

আল্লাহ্ তায়ালা মানুষকে দুনিয়ার বুকে তার প্রতিনিধি হিসাবে এবং কেবল তারই ইবাদাত করার জন্য সৃষ্টি করেছেনতিনি বিশ্ববাসীর প্রতি অনুগ্রহ স্বরূপ জীবন ব্যবস্থার পরিপূর্ণতা দান করেছেন এবং ইসলামকেই একমাত্র তার মনোনীত জীবন ব্যবস্থা হিসাবে ঘোষণা করেছেনরসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবাগণ (রাঃ) জীবনের সকল ক্ষেত্রে এর বাস্তব প্রয়োগের মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত অনাগত ভবিষ্যতের সকল মানুষের জন্য এর বাস্তব নমুনা রেখে গেছেনএই মহান দ্বীনের বাস্তবায়ন যখন আল্লাহর নিকট পরিপূর্ণভাবে গৃহীত হয়, তখন বিদায় হজের দিনে আল্লাহ্ ঘোষণা করেন : আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের জীবন ব্যবস্থাকে পূর্ণাংগ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকেই তোমাদের জন্য একমাত্র জীবন ব্যবস্থা হিসাবে মনোনীত করলাম - (সূরা মায়িদা : ৩)

সুতরাং ইসলাম কিয়ামত পর্যন্ত বিশ্ববাসীর জন্য একমাত্র অপরিহার্য জীবন ব্যবস্থারসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ইসলামের মূল  ভিত্তি পাঁচটিঃ যথা- সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ নাই এবং মুহাম্মাদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহ্ রসুল, সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, বায়তুল্লাহতে হজ্জ করা এবং রমজান মাসে সিয়াম করা - (বুখারী ও মুসলিম)

যাকাত ইসলামের একটি অন্যতম ভিত্তিআল্লাহ্ তায়ালা বলেন : তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা একনিষ্ঠভাবে ইখলাসের সাথে আল্লাহ্ ইবাদত করবে, সালাত কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে আর এটাই হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত দ্বীন -(সূরা বাইয়িনাহ : ৫)

তিনি আরও বলেন : আপনি তাদের ধন সম্পদ থেকে সদ্কাহ্ গ্রহণ করুন, তাদের পবিত্র করুন এবং তাদের অন্তঃকরণের সংশোধন করুন-(সূরা তাওবাহ : ১০৩)

সুতরাং সিয়ামের অন্যতম ল্ক্ষ্য যেমন তাকওয়া অর্জন তেমনি যাকাতের অন্যমত ল্ক্ষ্য হচ্ছে অন্তঃকরণের সংশোধনতিনি আরও বলেন : হে ঈমানদারগণ! তোমরা যে সমস্ত পবিত্র জিনিস উপার্জন করেছ তা হতে দান করআর জমিন থেকে আমি যে জিনিস বের করেছি তা হতেওতবে এর মধ্য থেকে শুধু খারাপ জিনিসগুলোই দান করো নাযদি এ ব্যাপারে গাফলতি না কর তবে তোমরা দোষী হবে না -(সূরা বাকারাহ : ২৬৭)

উশর প্রসংগে তিনি আরও বলেন : আর তোমরা ফসলের হকসমহ আদায় কর যেদিন তোমরা ফসল কর্তন কর সেদিনই-(সূরা আনআম : ১৪১)

মাহে রমজানের সাথে যাকাতের রয়েছে ঐতিহ্যগত সম্পর্কযেহেতু যাকাত চন্দ্রবর্ষ দ্বারা হিসাব করা হয় এবং আমাদের দেশে অধিকতর কল্যাণের আশায় সাধারনত রমজান মাসেই যাকাত আদায় করা হয়সুতরাং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দারিদ্র বিমোচন ও সামাজিক কল্যাণ সাধনে যাকাত আদায় ও বণ্টনের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন অতীব প্রয়োজনইসলামের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হিসাবে কারা যাকাত আদায় করবেন, কোন্ কোন জিনিসের যাকাত আদায় করবেন, যাকাতের সঠিক হিসাব কিভাবে করবেন, কোন্ কোন্ খাতে কিভাবে যাকাত আদায় করবেন এবং যাকাতের হকদারগণ কিভাবে যাকাত গ্রহণ করবেন এ সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান অর্জন করা যাকাত দাতা ও যাকাত গৃহীতা তথা সকল মুসলিম নর-নারীর জন্যই ফরজ বা একান্ত অপরিহার্যসাথে সাথে যাকাত আদায় না করা বা লোক দেখানো আদায় করার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কেও সবাইকে অবহিত, সচেতন ও সতর্ক করাও ইমাম, মুয়াল্লিম, মুবাল্লিগ ও উলামায়ে দ্বীনগণের পবিত্র জিম্মাদারী দায়িত্ব

স্বর্ণ, রৌপ্য ও অর্থ-সম্পদের যাকাত : যাদের নিকট বিশ দিনার (৮৫ গ্রাম বা সাড়ে সাত তোলা) স্বর্ণ বা দুইশত দিরহাম (৫৯৫ গ্রাম বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা) রৌপ্য বা এর যে কোন একটির (যেটি কম) মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ বা স্বর্ণ + রৌপ্য দুটির মূল্য মিলিয়ে যদি যে কোন একটির (যেটি কম) মূল্যের সমান হয়, শরীয়তের পরিভাষায় তাকে মালিকি নিসাব বলেমালিকি নিসাব এর নিকট যদি ঐ পরিমাণ স্বর্ণ রৌপ্য বা সম্পদ এক চন্দ্রবর্ষ মজুদ থাকে তবে তার উপর যাকাত ফরজ ক্ষেত্রে শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত আদায় করতে হবেমনে করুন, কোন মালিকে নিসাব ব্যক্তি ১ রমজান যাকাতের হিসাব করেনএক বছর পর পুনরায় ১ রমজান তার সর্বশেষ স্থিতির উপর তিনি তার যাকাতের হিসাব করবেনক্ষেত্রে  বছরের মাঝে যদি তার সম্পদ হ্রাস বৃদ্ধি পায় তবে তা যাকাতের হিসাবে কোনরূপ প্রভাব সৃষ্টি করবে নাযাকাত যার উপর ফরজ, তার প থেকেই আদায় করতে হবে, অন্য কেউ তার অনুমতি বা অনুরোধ (পাওয়ার অফ এটর্নী) ছাড়া আদায় করলে তা আদায় হবে না

স্বর্ণ রৌপ্য হিসাবকালীন প্রচলিত বাজারদরে মূল্য হিসাব করতে হবেস্বর্ণ-রৌপ্যের অলংকারের মাঝে সামান্য খাদ থাকলে তা স্বর্ণ-রৌপ্য হিসাবেই গণ্য করতে হবেস্বর্ণ-রৌপ্য ছাড়া অন্য কোন ধাতব পদার্থ, পাথর, আসবাবপত্র, পোষাক পরিচ্ছদ, বাড়ী-ঘর, জায়গা-জমি যা ব্যবহার করা হয় তা যতই মূল্যবান হোক না কেন, এর কোন যাকাত নেইকিন্তু উলেখিত জিনিস-পত্রসহ যে কোন ব্যবসায়িক পণ্য যা কেনা বেঁচার মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা  করা হয়, তখন ব্যবসায়িক পন্য হিসাবে তার মূল্যের উপর শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত আদায় করতে হয়উল্লেখ্য যে, ব্যবসায়ে নিয়োজিত (পণ্য ছাড়া) স্থায়ী সম্পদ যথা- অফিস, আসবাবপত্র, মেশিনারীজ, শিল্প-কারখানা ইত্যাদি যা পণ্য হিসাবে কেনা-বেচা করা হয় না তার উপর যাকাত ধার্য হয় নাকিন্তু মেশিনারীজ যদি ব্যবসায়ের পণ্য হয় তবে যাকাত হিসাবের দিনে তার সমুদয় মূল্য হিসাব করে যাকাত আদায় করতে হবে

নগদ অর্থ সম্পদ বলতে নগদ অর্থ, ব্যাংক সিন্দুক বা অন্যের নিকট গচ্ছিত আমানত, পাওনা, জামানত, শেয়ার, বন্ড, মেয়াদী জামানত ইত্যাদি সবগুলো হিসাব করতে হবেমনে করুন! কেহ ১ রমজান যাকাতের হিসাব করবেনতাহলে ঐ দিন তার নগদ জমা = তার নিকট নগদ কত টাকা আছে + ব্যাংকে কত টাকা জমা আছে + কোন শেয়ার থাকলে ঐ দিনে উক্ত শেয়ারের বাজার মূল্য + তার কোন মেয়াদী জামানত বা বন্ড কোথাও থাকলে তার মূল জামানত + বাসা বা দোকান ভাড়ার ক্ষেত্রে মালিককে প্রদত্ত জামানত + অন্যের নিকট পাওনা ইত্যাদি। নগদ জমা থেকে ঐ বছরে কোন খেলাপী ঋন থাকলে তা বিয়োগ করলে নগদ অর্থের হিসাব পাওয়া যাবে। অর্থাৎ, নগদ অর্থ = নগদ জমা - খেলাপী ঋন। এভাবে নগদ অর্থ হিসাব করে তার শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত আদায় করতে হবেযারা চাকুরি করেন তাদের জিপিএফ বা সিপিএফ তহবিলে সঞ্চিত অর্থ যদি বাধ্যতামমূলক কর্তন হয়, তাহলে তা নগদ জমার আওতায় যাকাতের হিসাবে আসবে না। আর যদি কর্তন বাধ্যতামূলক না হয় বা যদি বাধ্যতামূলকের অতিরিক্ত ইচ্ছাকৃত হয়, তাহলে উক্ত ইচ্ছাকৃত কর্তন জামানত হিসাবে নগদ অর্থের সাথে যোগ করে প্রতি বছর হিসাব করে যাকাত আদায় করতে হবে

সুদ, ঘুষ, প্রতারণা, রাহাজানী-ছিনতাই, চুরি-ডাকাতি, জুয়া-লটারীর, অবৈধ পেশা (যেমন-নাচ, গান, অভিনয়, জীব-জন্তুর ছবি অংকন, মুর্তি বা প্রতিকৃতি তৈরীকরণ, দেহ-ব্যবসা ইত্যাদি), অবৈধ চাকুরি, অবৈধ ব্যবসা (যেমন- মদের ব্যবসা, সিনেমার ব্যবসা), অবৈধ ব্যবসার শেয়ার, সুদ ভিত্তিক ব্যবসার শেয়ার ইত্যাদির মাধ্যমে যিনি প্রচুর অর্থ বৈভবের মালিক হয়েছেন তার উপার্জিত অর্থ যেহেতু তার জন্য হালাল নয় এবং যেহেতু তিনি ঐ সকল অর্থের প্রকৃত মালিক নন সুতরাং তার ঐ সকল অর্থের উপর যাকাত প্রদান করে নিজের জন্য হালাল বানানো আল্লাহ্ তায়ালার পবিত্র বিধান নিয়ে প্রতারণার সামিল।  যারা ইতিমধ্যে এর সাথে জড়িয়ে পড়েছেন তাদের ক্ষেত্রে পরিত্রাণের পথ হল- সমুদয় হারাম অর্থ তার মালিককে খুঁজে বের করে ফেরত দেয়া এবং তার কাছে ক্ষমা চাওয়াআর তা সম্ভব না হলে সে সব অর্থ সম্পদ প্রকৃত মালিকের নামে সওয়াবের আশায় দান করে দেয়া এবং আল্লাহর কাছে খাস দিলে তওবা করাআসুন! আমরা পবিত্র মাহে রমজানে আল্লাহর দরবারে খাস তওবা করি এবং ক্ষমা প্রার্থনা করি

ব্যবসায়ী মালের যাকাত : কোন ব্যক্তির যাকাতের হিসাবের জন্য নির্ধারিত দিনে ব্যবসায়ে নিয়োজিত পণ্য সামগ্রীর ঐদিনের বাজার দরে মল্য হিসাব করে ২.৫% যাকাত দিতে  হবে, ক্ষেত্রে ঐ পণ্য এক বছর যাবত গুদামজাত থাকা শর্ত নয়বাজার দর যাচাই করা সম্ভব না হলে ক্রয় মূল্যে ব্যালেন্স হিসাব করা যাবেব্যবসায়ে নিয়োজিত ব্যবহারিক সম্পদ যেমন- অফিস, বাহন, কারখানা ইত্যাদির মূল্য যাকাতের হিসাবে আসবে নাযৌথ ব্যবসার ক্ষেত্রে যাকাত প্রদানে ইচ্ছুক ব্যক্তি নিজের অংশ হিসাব করে যাকাত আদায় করবেনতবে যারা যাকাত প্রদানে ইচ্ছুক নন, ব্যবসায় হারাম-হালালের তোয়াক্কা করেন না, ব্যবসার সাথে সুদ-ঘুষ, প্রতারণা ও জুলুমকে মিশ্রিত করেন- তাদের সাথে যৌথ ব্যবসা করা বা তাদের ব্যবসায়ের শেয়ার কেনা-বেচা করে লাভবান হওয়া কোন মুসলমানের জন্য বৈধ নয়এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে

ফসলের যাকাত : ফসলের যাকাতকে ইসলামের পরিভাষায় উশর বলা হয়। ধান, গম, জব, ভুট্টা, খেজুর ইত্যাদি যেসব ফসল সারা বছর সংরণ করা যায়, যদি সে সকল ফসল উশরী জমিতে উৎপন্ন হয় তার নিছাব হল ৫ আওচাক (৬১২ কেজি) ক্ষেত্রে যদি বৃষ্টি বা নদ-নদীর পানিতে উৎপন্ন হয় তাহলে শতকরা দশ ভাগ এবং যদি সেচের পানিতে উৎপন্ন হয় তাহলে শতকরা পাঁচ ভাগ যাকাত আদায় করতে হবেআমাদের দেশের কৃষকগণ সাধারণত দারিদ্র সীমার নীচে বাস করে তাই এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হল নাযার অনেক জমি আছে এবং প্রচুর ফসল উৎপন্ন হয়, তিনি নির্ভরযোগ্য আলেমে-দ্বীনের সংগে আলোচনা করে তার যাকাত আদায় করবেনসে সকল শাক-সব্জী, ফল-মুল, তরি-তরকারী পচনশীল তার উপর যাকাত ধার্য হয় নামনে রাখবেন! সরকারী বিধানানুযায়ী আয়কর দিলেও যেমন যাকাত আদায় করতে হয়, তেমনি উশরী জমির খাজনা দিলেও তাতে উশর আদায় করতে হয়

গবাদী পশুর যাকাত : উট সর্বনিম্ন ৫টি হলে একটি এক বছরের ছাগল, গরু-মহিষ সর্বনিম্ন ৩০টি হলে একটি এক বছরের বাছুর, ছাগল-ভেড়া সর্বনিম্ন ৪০টি হলে একটি এক বছরের ছাগল-ভেড়া যাকাত দিতে হবেযদি সেগুলো সারা বছর চারণ ভূমি বা মাঠে চরে ঘাস খায় এবং মালিককে পরিশ্রম করে বা অর্থ ব্যয় করে পশু খাদ্যের যোগান দিতে না হয়আমাদের দেশের কিছু কিছু অঞ্চল বাদে এর প্রয়োগ খুবই কমতাই যার যাকাত হতে পারে বলে মনে হবে, তিনি নির্ভরযোগ্য আলেমে-দ্বীনের সংগে আলোচনা করে তার যাকাত হিসাব করবেনযিনি উট, গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি কেনা-বেচার ব্যবসা করেন তার জন্য কিন্তু উক্ত হিসাব প্রযোজ্য নয় বরং তিনি ব্যবসায়ের পণ্য হিসাবে যাকাত হিসাবের দিনে তার কাছে যে কয়টিই থাকুক না কেন তার বাজার-দর হিসাব করে ব্যবসার পন্য হিসাবে যাকাত আদায় করবেনবাজার দর যাচাই করা সম্ভব না হলে ক্রয় মূল্যে ব্যালেন্স হিসাব করা যাবে

গুপ্ত ধন-সম্পদের যাকাত :  মাটির নীচে প্রোথিত বা গুপ্ত ধন-সম্পদ বা খনিজ সম্পদ যার জমিতে পাওয়া যায় তিনি এর মালিক হলে পরিমাণ যাই হোক না কেন এর শতকরা বিশ ভাগ যাকাত দিতে হবেআমাদের দেশে এসব সম্পদ সরকারী সম্পত্তি হিসাবে গণ্য হয় এবং সরকারী কোষাগারে জমা দিতে হয় বিধায় যাকাতের হিসাবের আওতায় এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করার প্রয়োজন পড়ে নাএ ব্যাপারে প্রয়োজনবোধে নির্ভরযোগ্য আলেমে-দ্বীনের সংগে আলোচনা করে তার পরামর্শ মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন

যাকাত কাদেরকে দিতে হবে : যারা মালিকি নিসাব বা যাকাত দাতা নন তারাই যাকাত পাওয়ার হকদারআল্লাহ্ তায়ালা বলেন : সদ্কাহ্ শুধুমাত্র ফকির, মিসকিন, যাকাত সংগ্রহকারী কর্মচারী, যাদের অন্তর ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা আছে, ক্রীতদাস মুক্তিতে, যারা ঋণগ্রস্থ, আল্লাহর রাস্তা এবং যারা রাস্তার পথিক এর জন্যএটা আল্লাহর তরফ থেকে ফরজআল্লাহ সব কিছুই জ্ঞাত আছেন আর তিনি হিকমতওয়ালা - (সূরা তওবাহ্ : ৬০)

বাংলাদেশে সরকারীভাবে যাকাত আদায় ও বন্টনের কোন ব্যবস্থাপনা না থাকায় প্রত্যেক মালিকি নিসাবকে ব্যক্তিগত বা সংঘবদ্ধভাবে যাকাত আদায়ে তৎপর হতে হবে ক্ষেত্রে আত্মীয়-স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে যারা অভাবী (ইয়াতীম-মিসকীন) এবং দ্বীনি ইলম শিক্ষা করা ও শিক্ষা দানে যারা নিয়োজিত তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবেযাকাত আদায়ের খাতসমুহের মধ্যে যতগুলো খাতে যাকাত আদায় করা যায় ততই উত্তম

যাকাত কিভাবে আদায় করতে হবে : যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, যাকাত গরীবের প্রতি কোন অনুগ্রহ নয় যে, আমাদের দুয়ারে দুয়ারে এসে হাত পাততে হবেবরং যাকাত হল তাদের পাওনা যা তাদের দুয়ারে হাজির হয়ে আমাদেরকেই শোধ করতে হবেআমাদের দেশে অনেক ধনী ব্যক্তি মাইকিং করে ব্যবহার অযোগ্য যাকাতের শাড়ী আর লুঙ্গী দিয়ে যাকাত আদায় করেন যা সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক দরিদ্র ব্যক্তি পদপিষ্ট হয়ে মারা যান আবার যাকাত দাতা মনে মনে এ আকাংখাও পোষণ করেন যে, এর বিনিময়ে এরা তার অনুগত থাকবে আর নির্বাচনের সময় তাকেই ভোট দেবে এরূপ লোক দেখানো মহড়ার মাধ্যমে যাকাত আদায় হতে পারে নাকারণ যাকাত ইসলামের একটি অন্যতম ভিত্তি এবং পবিত্র ইবাদতঐ সব যাকাত দাতাগণ আল্লাহ্ পাকের ইবাদতকে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য লোক দেখানো খেলায় পরিণত করেছেযাকাতের মহান ল্য হল সমাজ থেকে দারিদ্র দুর করা এবং অভাবী জনগোষ্ঠীকে এককালীন অর্থ প্রদানের মাধ্যমে তাদেরকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলাকবির ভাষায়- নবীর শিক্ষা করো না ভিক্ষা, মেহনত কর সবে- এর বাস্তবায়নঅভাবী লোকদেরকে কিছু কিছু টাকা দিলে তাদের হাতকে কর্মীর হাতের পরিবর্তে ভিখারীর হাতে পরিণত করা হবে

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহে অনেক অভাবী পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি শহীদ হয়েছেন আবার অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন- সম্মানজনকভাবে সে সব পরিবারের পুনর্বাসন করা স্থানীয় মুসলমানদের পবিত্র দায়িত্বএছাড়া দেশের সম্মানিত ওলামাগণের সাথে জনগোষ্ঠির একটি অংশের দুরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় ইয়াতিমখানা ও লিল্লাহ বোডিং-এ বছর যাকাত কালেকশন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছেএমতাবস্থায় যারা ওলামায়ে কেরাম, তলেবে ইলম  এবং দ্বীনি প্রতিষ্ঠানসমূহের ইয়াতীমখানা ও লিল্লাহ বোডিং মহব্বত করেন, তাদেরকে এসব খাতে বিগত বছরের তুলনায় দ্বিগুন/ ত্রিগুন হারে যাকাত প্রদান করে উক্ত ক্ষতি পুষিয়ে দেওযার জন্য আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে

আয়কর বনাম যাকাত : মনে করুণকোন ব্যক্তি গত বছর ১ রমজান বিশ লাখ টাকার মালিক ছিলেনতিনি এই টাকা খাটিয়ে নীট তিন লাখ টাকা আয় করেছেন অথবা তিনি চাকুরি করে করযোগ্য তিন লাখ টাকা উপার্জন করেছেন ক্ষেত্রে সরকারী বিধি মোতাবেক তার আয়কর বাবদ আদায় হবে (৩,০০,০০০-১,৮০,০০০কর রেয়াত =১,২০,০০০) এর ১০% =১২,০০০/- টাকাএরপর এখানে কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা তো আছেইআর এখানে যাকাতের হিসাবে তাকে প্রদান করতে হবে (২০০০০০০ + ৩০০০০০ =২৩০০০০০) এর ২.৫% =৫৭,৫০০/- টাকাসরকারের পক্ষ থেকে যদি আয়করের পাশাপাশি যাকাতের (আয়কর অথবা যাকাত যে একটি গ্রহণের) অপশন চালু থাকত তাহলে ধার্মিক মুসলিমগণ সবাই ফরজ ইবাদত হিসাবে কোন প্রকার ফাকিবাজী ছাড়াই অকুণ্ঠ মনে যাকাত আদায় করতেন এবং সরকারেরও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ও দারিদ্র বিমোচনে অধিকতর সুযোগ সৃষ্টি হতবিষয়টি গুরুত্ব সহকারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভেবে দেখা প্রয়োজন

দারিদ্র বিমোচনে যাকাত : নামাজের ন্যায় যাকাতও একটি সামষ্টিক ইবাদতমুসলিম সমাজের কেন্দ্র হল মসজিদ, যেখানে সবাই জামায়াতের সাথে সালাত আদায় করেনমনে করুণ! ঐ মসজিদকে কেন্দ্র করে মহল্লার মাঝে যারা যাকাত দাতা রয়েছেন তাদের যাকাতগুলো হিসাব করে একত্রিত করা হল, যার পরিমাণ হল এক লক্ষ টাকাএরপর ঐ মহল্লা থেকে অভাবীদের একটি তালিকা তৈরী করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দশটি পরিবারকে বাছাই করে প্রত্যেক পরিবারকে ১০০০০/- টাকার মধ্যে উপার্জনযোগ্য কোন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হল, যাতে ভবিষ্যতে আর কারো কাছে হাত পাততে না হয়যেমন- যে পরিবারের কর্তা একজন শক্তিমান পুরুষ তাকে একটি ভ্যান বা মাঝারি নৌকা কিনে দেয়া হল, যে পরিবারের কর্তা একজন বয়োবৃদ্ধ পুরুষ তাকে একটি ছোট পান-চায়ের দোকান করে দেয়া হল আর যে পরিবারের প্রধান একজন বিধবা মহিলা তাকে একটা ভাল সেলাই মেশিন কিনে দেয়া হল- যাতে এগুলো ব্যবহার করে তারা দৈনন্দিন আয়-রোজগার করে সংসার চালাতে পারেএভাবে প্রতি বছর যদি মহল্লার দশটি পরিবারকে স্বাবলম্বী করা যায় তাহলে মদীনায় যেমন হযরত ওসমান (রাঃ) এর খিলাফতকালে যাকাত নেয়ার মত লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি তেমনি ২০ বছর পর হয়ত ঐ মহল্লায়ও যাকাত নেয়ার মত কোন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে নামহল্লার লোকজন সুদী মহাজন, সুদী এনজিও ও সুদী ব্যাংকসমূহের সুদের ছোবল থেকে মুক্তি পাবে, মহল্লায় তাকওয়া, শান্তি ও সমৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি হবেএজন্য প্রয়োজন হল সম্মিলিত সামাজিক অংগীকার

যাকাত আদায় করার উপকারিতা : যাকাত আদায়ের মাধ্যমে সম্পদ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়আল্লাহ্ তায়ালা বলেন : যারা আল্লাহর রাস্তায় ধন- সম্পদ খরচ করে তাদের উদাহরণ হচ্ছে ঐ শস্য দানার মত যার থেকে সাতটি শিষ বের হয় এবং প্রত্যেকটি শিষে শতাধিক দানা হয় আর আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা তাকে আরও বাড়িয়ে দেন। -(সূরা বাকারাহ : ২৬১)

যাকাতের মাধ্যমে আল্লাহর খাস রহমত লাভ করা যায়আল্লাহ্  তায়ালা বলেন : আমার রহমত সব কিছুর উর্ধ্বে আর আমি লিখব ঐসব মানুষের জন্য যারা আল্লাহ্কে ভয় করে ও যাকাত আদায় করে। - (সূরা আরাফ : ১৫৬)

যাকাতের মাধ্যমে আল্লাহ্ তরফ থেকে উত্তম বিনিময় ও হেফাজতি লাভ করা যায়আল্লাহ্ তায়ালা বলেন : যারা সোনা রূপা জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহ্ রাস্তায় ব্যয় করে না, তাদের কঠিন আজাবের সুসংবাদ দাওকিয়ামতের দিন ঐ সমস্ত ধাতুকে জাহান্নামের আগুনে গরম করে সেটা দিয়ে তাদের কপালে, শরীরের পার্শ্বে ও পিঠে ছেক দেয়া হবে। (আর বলা হবে) এটা হচ্ছে ঐ সম্পদ জমানোর শাস্তি যা তোমরা জমা করে রেখেছিলে নিজেদের জন্য আর ঐ জমা রাখার শাস্তির আস্বাদ গ্রহণ কর।- (সূরা তওবা : ৩৪-৩৫)

রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : যদি সোনা বা রুপার অধিকারী কোন ব্যক্তি এর হক (যাকাত) ঠিকমত আদায় না করে তবে কিয়ামতের দিন ঐ সমস্ত ধাতুকে পাত বানানো হবে আর তাকে জাহান্নামের আগুনে গরম করা হবে, অতঃপর তা দিয়ে তার কপালে, শরীরের পার্শ্বদেশে ও পিঠে ছেক দেয়া হবেযতবারই তা ঠান্ডা হয়ে আসবে ততবারই আবার গরম করে দেয়া হবে, এমন এক দিনে যা হবে পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান। - (সহীহ মুসলিম)

আল্লাহ্ তা’য়ালা আমাদের সবাইকে তার খাস মাহবুব বান্দাহ ও রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাহবুব উম্মতগণের অন্তর্ভূক্ত করুন! খাঁটি মসলিম হিসাবে দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার তৌফিক দিন! রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবী (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)-গণের সংগে আমাদের হাশর করুন! আ-মী-ন


No comments:

Post a Comment