পরিবার গঠন ও বিবাহ সংক্রান্ত ইসলামী নীতিমালা
ডাঃ গাজী মোঃ নজরুল ইসলাম
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা'য়ালার জন্য- যিনি রব্বুল আ'লামীন। দুরদ ও
সালাম রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি যিনি রহমাতুল্লিল আ'লামীন, তাঁর পরিবারবর্গ ও বংশধর, সাহাবায়ে কিরাম (রাদিআল্লাহু আনহুম) ও সালিহীন (র) বান্দাগণের প্রতি। আমরা
সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই এবং মুহাম্মাদ
(সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর বান্দা ও তার রসুল। নিশ্চয়ই শুভ পরিণতি
কেবলমাত্র মুত্তাকীনদের জন্যই নির্ধারিত।
বিবাহের
মাধ্যমেই মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশঃ এপসংগে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন: “হে মানবজাতি,
আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং
তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে
তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক
তাকওয়াসম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন”। -[আল কুরআন: সূরা
হুজুরাত, আয়াত ১৩]
নারী-পুরুষ
সৃষ্টি মহান আল্লাহ তা’য়ালার অন্যতম অনুপম নিদর্শনঃ এ প্রসংগে
তিনি বলেন: “তাঁর (আল্লাহর) অন্যতম একটি নিদর্শন যে, তিনি
তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক
সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী
রয়েছে।” -(সূরা রোম: আয়াত ২১)
যারা বিবাহে
সামর্থ নয়, তারা যেন সংযম অবলম্বন করেঃ এ প্রসংগে তিনি বলেন: “যারা
বিবাহে সামর্থ নয়, তারা যেন সংযম অবলম্বন করে যে পর্যন্ত না আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে
তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেন। তোমাদের অধিকারভুক্তদের মধ্যে যারা মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তি করতে চায়, তাদের
সাথে তোমরা লিখিত চুক্তি কর যদি জান যে, তাদের মধ্যে কল্যাণ
আছে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে, অর্থ-কড়ি দিয়েছেন, তা থেকে তাদেরকে দান কর। তোমাদের দাসীরা
নিজেদের পবিত্রতা রক্ষা করতে চাইলে তোমরা পার্থিব জীবনের সম্পদের লালসায় তাদেরকে
ব্যভিচারে বাধ্য কারো না। যদি কেহ তাদের উপর জোর-জবরদস্তি করে, তবে তাদের উপর জোর-জবরদস্তির পর আল্লাহ তাদের প্রতি ক্ষমাশীল, পরম
দয়ালু।” -[সূরা আন-নূরঃ আয়াত ৩৩]
বিবাহের
মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহে আর্থিক সচ্ছলতা আসেঃ এ প্রসংগে তিনি বলেন :
"তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত , তাদের বিবাহ সম্পাদন
করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে
তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ”। -(সূরা নুরঃ আয়াত ৩২)
দাম্পত্য জীবনে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী একে অপরের অভিভাবক
ও বন্ধুঃ এ প্রসংগে তিনি বলেন: “মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী একে অপরের অভিভাবক ও বন্ধু।
তারা ভাল কাজের আদেশ দেয়, খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে, সালাত কায়িম
করে, যাকাত আদায় করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে।
আল্লাহ তাদের প্রতি অচিরেই রহমত নাযিল করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রশালী,
মহাপ্রজ্ঞাময়। আল্লাহ মুমিন পুরুষ ও নারীদের জন্য এমন জান্নাতের
অঙ্গীকার করেছেন যে জান্নাতের নিচ দিয়ে ঝর্ণাসমূহ বয়ে যায়। সেখানে তারা চিরদিন
থাকবে। আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেন মহাপবিত্র স্থায়ী বাসস্থান আদন নামক
জান্নাতের। বস্তুত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং এটাই সবচেয়ে বড় সফলতা”।- (সূরা তওবাঃ আয়াত ৭১-৭২)
হিন্দু, বৌদ্ধ ও
অন্যান্য মুশরিকদের সাথে বিবাহ বন্ধনঃ আল্লাহ তা’য়ালা বলেন : "মুমিন না হওয়া
পর্যন্ত কোন মুশরিক নারীকে বিয়ে কর না, যদিও সে তোমাদেরকে মুগ্ধ করে; মুশরিক নারীর চেয়ে মুমিন দাসীরা উত্তম। আর তোমরা মুশরিক পুরুষকে বিয়ে কর না
যতণ না তারা ঈমান আনে, যদিও সে তোমাদেরকে মুগ্ধ করে; মুমিন দাস তাদের চেয়ে উত্তম। মুশরিক নারী ও পুরুষ তোমাদেরকে জাহান্নামের দিকে
ডাকে আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তোমাদেরকে জান্নাত ও মার প্রতি আহ্বান করেন। তিনি মানুষের
জন্য তাঁর বিধানসমূহ সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করেন, যেন তারা তা
স্মরণ রাখে ও মেনে চলে।" - (সূরা বাকারাহ : আয়াত-২২১)
ইয়াহুদী-খৃষ্টানদের সাথে বিবাহ
বন্ধনঃ
সমাজে কতিপয় লোককে ইয়াহুদী-খৃষ্টানদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে দেখা যায়। অথচ
তাদের কুফরী, শিরকী
ও আল্লাহর মনোনীত দ্বীনের সুস্পষ্ট
বিরোধিতা প্রসংগে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন : ইয়াহুদীরা
বলে- ‘উযায়র আল্লাহর পুত্র।’ খৃষ্টানরা বলে: ‘মসীহ আল্লাহর পুত্র।’ এটা কেবলই তাদের মুখের অবাস্তব
কথা। ইয়াহুদী-খৃষ্টানরা তাদেরই মত কথা বলে যারা তাদের আগে কুফরি করেছিল। আল্লাহ
তাদের ধ্বংস করুন, তারা
উল্টো কোন দিকে যাচ্ছে? আল্লাহকে
বাদ দিয়ে তারা তাদের জ্ঞানী ব্যক্তিদের ও ধর্মযাজকদেরকে এবং মারইয়াম পুত্র মসীহকে
প্রতিপালক হিসেবে গ্রহণ করেছে। অথচ তারা একমাত্র ইলাহ আল্লাহর ইবাদাত করার জন্য
আদিষ্ট হয়েছিল। আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তারা যাকে (আল্লাহর) শরীক সাব্যস্ত করে
তা হতে তিনি পবিত্র। তারা তাদের মুখের ফুঁৎকার দিয়ে আল্লাহর নূর নিভিয়ে দিতে চায়।
কিন্তু কাফিরদের অপছন্দ হলেও আল্লাহ তা‘আলা
তাঁর নূরকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করা ছাড়া আর কিছু চান না। সকল দীনের উপর
সুপ্রকাশিত ও জয়যুক্ত করার জন্য আল্লাহ তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সঠিক দীনসহ প্রেরণ
করেছেন, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে। -(
সূরা তওবা : আয়াত ৩০-৩৩)
মুসলিম নামধারী মুশরিক ও তাগুতের সাথে বিবাহ বন্ধনঃ মুসলিম সমাজের মাঝে যারা মুসলিম নামধারী হয়েও বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিরক, কুফর, নিফাক ও তাগুতের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে বা জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর সুমহান আদর্শের বিরোধিতায় লিপ্ত রয়েছে বা সমাজ ও সভ্যতার বিনির্মানে এবং আইন ও বিধি-বিধান পালনে কুরআন ও সুন্নাহকে অচল বলে পিছনে ফেলে রেখেছে-তারাও আল্লাহর দরবারে মুশরিক হসাবেই গণ্য। খাটি তওবা না করা পর্যন্ত তাদের সাথে কোন মুমীন নর-নারীর বিবাহ বৈধ নয়।
প্রকাশ্য
ব্যভিচারে লিপ্ত ও চরিত্রহীনদের খাটি মুমীন নর-নারীর বিবাহ বৈধ নয়ঃ এ প্রসংগে মহান আল্লাহ
তায়ালা বলেন: “ব্যভিচারী পুরুষ কেবল ব্যভিচারিণী নারী অথবা মুশরিকা নারীকেই বিয়ে
করে এবং ব্যভিচারিণীকে কেবল ব্যভিচারী অথবা মুশরিক পুরুষই বিয়ে করে এবং এদেরকে
মুমিনদের জন্যে হারাম করা হয়েছে”। -(সূরা আন- নুর, আয়াতঃ ৩)
তিনি আরও বলেন : “দুশ্চরিত্রা মহিলারা দুশ্চরিত্র পুরুষদের জন্য এবং
দুশ্চরিত্র পুরুষরা দুশ্চরিত্রা মহিলাদের জন্য। সচ্চরিত্রা মহিলারা সচ্চরিত্র
পুরুষদের জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষরা সচ্চরিত্রা মহিলাদের জন্য । লোকে যা বলে তা
থেকে তারা পূত-পবিত্র। তাদের জন্য রয়েছে মাগফিরাত ও মর্যাদাপূর্ণ জীবিকা।” -(সুরা
নুর: আয়াত ২৬)
বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর দ্বীনদারীকেই গুরুত্ব দিতে
হবেঃ
হযরত আবু হুরাইরা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন : চারটি বিষয় বিবেচনা করে কোন মেয়েকে বিবাহ করা হয়- (১) তার
ধন-সম্পদ, (২) তার বংশ-মর্যাদা, (৩) তার রূপ-সৌন্দর্য্য ও (৪)
তার ধর্ম-পরায়ণতা। এর মধ্যে ধর্মপরায়ণ স্ত্রী লাভে তুমি সফলকাম হও। তোমার হাত
কল্যাণে ভরপুর হবে। -(বুখারী ও মুসলিম)
বিবাহের ফায়দাঃ হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাস’উদ রাদিয়াল্লাহু
আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ হে যুবকরা! তোমাদের কেউ বিবাহ করতে সক্ষম হলে সে যেন
দ্রুত বিবাহ করে নেয়। কারন,তা চুক্ষুকে নিম্নগামী করে ও
লজ্জাস্থান কে করে পবিত্র। আর যে ব্যক্তি বিবাহ করতে সক্ষম নয় সে যেন রোযা রাখে।
কারন,তা সত্যি যৌন উত্তেজনা প্রশমনকারী। -(বুখারিঃ হাদিস-৫০৬৫
ও মুসলিমঃ হাদিস-১৪০০)
বিবাহের মাধ্যমে পারিবারিক জীবনের দায়িত্ব অর্পিত হয়ঃ হযরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু
‘আনহু
থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি : তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককে তার অধীনস্তদের
সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আমির বা শাসক তার অধীনস্থ লোকদের দায়িত্বশীল,
তাকে তার দায়িত্ব
পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ব্যক্তি তার পরিবার পরিজনের দায়িত্বশীল,
তাকে তার দায়িত্ব
পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীর সংসারের দায়িত্বশীল,
তাকে তার দায়িত্ব
পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। খাদেম তার মনিবের ধন- সম্পদের হেফাজতকারী,
তাকে তার দায়িত্ব
পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। কাজেই তোমরা সবাই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককে তার
দায়িত্ব পালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
-(বুখারী ও মুসলিম)
আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সবাইকে বিবাহের মুলনীতিসমূহ আরও বিস্তারিতভাবে জানার,
উপলব্ধি করার ও অনুসরণ করার মাধ্যমে মহান আল্লাহ তা’য়ালার সন্তোষ মোতাবেক সুমধুর ও
কল্যাণময় পারিবারিক জীবন গঠন করার তৌফিক দান করুন! আ-মীন।
No comments:
Post a Comment