Thursday, December 3, 2015

পারিবারিক জীবনে হিজাবের ফরজ বিধান পালন


পারিবারিক জীবনে হিজাবের ফরজ বিধান পালন
ডাঃ গাজী মোঃ নজরুল ইসলাম

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা'য়ালার জন্য যিনি রব্বুল আলামীনদুরুদ ও সালাম রসূলুল্লাহ্ সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি যিনি রহমাতুল্লিল আলামীন, তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কিরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) এবং সালেহীন (র)-গণের প্রতিআমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাইআমরা আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর বান্দাহ ও রসূলনিশ্চয়ই শুভ পরিণতি শুধুমাত্র মুত্তাকীনদের জন্য নির্ধারিত।

হিজাব বা পর্দা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান হিজাব শুধুমাত্র নারীদের উপর চাপিয়ে দেয়া কোন বিধান নয়,বরং পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্যই ফরজ এ বিধান যথাযথভাবে পালনের জন্য পুরুষ ও নারী একে অপরের সহায়ক মানবিক মুল্যবোধ নৈতিক মান সংরক্ষণে পর্দার গুরুত্ব অপরিসীম

পুরুষদের হিজাব প্রসংগে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ "(হে রাসূল!) আপনি মুমিন পুরুষদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গর হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন।" -{সূরা নূরঃ আয়াত ৩০ }

পুরুষদের চোখের হিফাজতের ফজিলতঃ হযরত আবু রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া ইরশাদ করেন, যে মুসলমানের প্রথম (অনিচ্ছাকৃত) দৃষ্টি কোন মহিলার সৌন্দর্যের  প্রতি পড়ে আর সে সাথে সাথে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় আল্লাহ তাআলা তাকে এমন এক ইবাদতের তাওফীক দান করেন যার স্বাদ সে অন্তরে অনূভব করতে থাকে। -(আহমাদঃ ৫/২৬৪, মেশকাতঃ ২৭০, তারগীবঃ ৩/২৩)

ঘরের ভিতরে নারীদের হিজাব প্রসংগে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ "(ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।
- (সূরা নূরঃ আয়াত ৩১)

ঘরের ভিতরে পরিবারের সদস্যদের চলাফেরা প্রসংগে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ "হে মুমিনগণ! তোমাদের দাসদাসীরা এবং তোমাদের মধ্যে যারা প্রাপ্ত বয়স্ক হয়নি তারা যেন তিন সময়ে তোমাদের কাছে অনুমতি গ্রহণ করে, ফজরের নামাযের পূর্বে, দুপুরে যখন তোমরা বস্ত্র খুলে রাখ এবং এশার নামাযের পর। এই তিন সময় তোমাদের দেহ খোলার সময়। এ সময়ের পর তোমাদের ও তাদের জন্যে কোন দোষ নেই। তোমাদের একে অপরের কাছে তো যাতায়াত করতেই হয়, এমনি ভাবে আল্লাহ তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ বিবৃত করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। তোমাদের সন্তান-সন্ততিরা যখন বায়োপ্রাপ্ত হয়, তারাও যেন তাদের পূর্ববর্তীদের ন্যায় অনুমতি চায়। এমনিভাবে আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহ তোমাদের কাছে বর্ণনা করেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।" -(সূরা আন নূরঃ আয়াত ৫৮-৫৯)

ঘরের বাইরে পর্দার কঠোরতা বা হিজাবের সাথে জিলবার ব্যবহার প্রসংগে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ "হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিনদের স্ত্রীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের জিলবাবের কিছু অংশ নিজেদের উপর ঝুলিয়ে দেয়। তাদেরকে চেনার ব্যাপারে এটাই সবচেয়ে কাছাকাছি পন্থা হবে। ফলে তাদেরকে কষ্ট দেয়া হবে না। আর আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়াময়।" 
-[সূরা আহযাবঃ আয়াত ৫৯]

পারিবারিক জীবনে নিকট আত্মীয়-স্বজনদের সাথে পর্দার বিধানঃ হযরত ওকবা ইবনে আমের জুহানী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন : "তোমরা নারীদের নিকট যাওয়া থেকে বিরত থাক। এক আনসারী সাহাবী আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! স্বামী পক্ষীয় আত্মীয় সম্পর্কে আপনি কী বলেন? তিনি বললে, সে তো মৃত্যু।" -[বুখারীঃ ৯/২৪২, মুসলিমঃ ২১৭২, তিরমিযীঃ ১১৭১, আহমাদঃ ৪/১৪৯, ১৫৩]

পুরুষদের সাথে পুরুষদের এবং মহিলাদের সাথে মহিলাদেরও পর্দা রয়েছেঃ হযরত আবু সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ "পুরুষদের পুরুষদের প্রতিও পর্দা আছে; তেমনি, মহিলাদের মহিলাদের প্রতিও পর্দা আছে। কোন পুরুষ অন্য পুরুষের সতরের দিকে তাকাবে না এবং কোন নারী অন্য নারীর সতরের দিকে তাকাবে না। দুজন পুরুষ লোক একত্রে একই কাপড়ে জড়াজড়ি করে ঘুমাবে না। অনুরূপভাবে দুজন মহিলাও একত্রে একই বস্ত্রে জড়াজড়ি করে ঘুমাবে না।" - (মুসলিম)

মহিলাদেরকেও দৃষ্টির হিফাজত করতে হবেঃ উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,আমি একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ছিলাম। উম্মুল মুমিনীন মায়মুনা রাদিয়াল্লাহু আনহাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম উপস্থিত হলেন। এটি ছিল পর্দা বিধানের পরের ঘটনা। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা তার সামনে থেকে সরে যাও। আমরা বললাম, তিনি তো অন্ধ, আমাদেরকে দেখছেন না? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরাও কি অন্ধ? তোমরা কি তাকে দেখছ না? - [সুনানে আবু দাউদঃ ৪১১২ ও ৪৩৬১, তিরমিযীঃ ২৭৭৯ ও৫১০২, মুসনাদে আহমাদঃ ৬২৯৬, শরহুল মুসলিমঃ নববী ১০৯৭ এবং ফাতহুল বারীঃ ৯/২৪৮]  

আজকাল অনেক পর্দানশীল পরিবারের কোন কোন মহিলাকে বেড়ার ফাক দিয়ে বা দরজা-জালানার পর্দার ফাক দিয়ে নতুন বর, নতুন জামাই বা গাইরে মাহরাম পুরুষদের দেখার প্রবনতা পরিলক্ষিত হয়- যা সম্পূর্ণ হারাম।

গায়রে মাহরাম নারী-পুরুষের একান্ত সাক্ষাতে শয়তান উপস্থিত থাকেঃ হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : "যখনই কোনো পুরুষ কোনো নারীর সাথে একান্তে সাক্ষাত করে তখন তাদের তৃতীয়জন হয় শয়তান।"   - [জামে তিরমিযী]

সাদৃশ্য গ্রহণকারী নারী-পুরুষগণ অভিশপ্তঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই সব পুরুষের উপর লানত করেছেন, যারা নারীদের সাদৃশ্য গ্রহণ করে (তাদের মতো আকৃতি, তাদের পোশাক ও তাদের চাল-চলন গ্রহণ করে);আর সেই সব নারীর উপরও লানত করেছেন, যারা পুরুষের সাদৃশ্য গ্রহণ করে। - [সহীহ বুখারী]

অত্যাচারী পুরূষ ও বেপর্দা নারীগণ জান্নাতে প্রবেশ করবে নাঃ হযরত আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ "জাহান্নামবাসী দুটি দল রয়েছে। যাদেরকে আমি এখনো দেখিনি। একদল এমন লোক যাদের হাতে গরুর লেজের মত লাঠি থাকবে যা দিয়ে তারা লোকদেরকে প্রহার করবে। আর অন্য দল এমন নারী যারা পোশাক পরেও উলঙ্গ থাকে। তারা অন্যদের তাদের প্রতি আকৃষ্ট করবে নিজেরাও অন্যদের প্রতি ঝুঁকবে। তাদের মস্তক উটের পিঠের কুঁজের মত হবে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এমনকি জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ এর ঘ্রাণ এত এত দূর থেকেও পাওয়া যায়।" 
- [মুসলিমঃ ২১২৮]

আধুনিকতা ও প্রগতির নামে হিজাবের ফরজ বিধানের প্রতি শৈথিল্য, আলস্য, অবহেলা,অবজ্ঞা ও বিরোধীতা মুসলিম সমাজের ফ্যাসন হয়ে দাড়িয়েছে পর্দা লংঘন ও অবাধ মেলামেশাকে সমাজে উৎসাহিত করা হচ্ছে ফলে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা বর্তমান মুসলিম সমাজের সর্বত্র মারাত্মকভাবে  মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে আর সমাজের নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ ধ্বংস হচ্ছে

তিনি আরও বলেনঃ "হে মানবসমাজ, পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তু-সামগ্রী থেকে আহার কর। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে নিঃসন্দেহে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। সে তো এ নির্দেশই তোমাদিগকে দেবে যে, তোমরা অন্যায় ও অশ্লীল কাজ করতে থাক এবং আল্লাহর প্রতি এমন সব বিষয়ে মিথ্যারোপ কর যা তোমরা জান না।" -[সূরা বাকারাহঃ আয়াত ১৬৮-১৬৯]

মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার ঘটানোর পরিনামঃ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন : যারা পছন্দ করে যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার ঘটুক তাদের জন্য পৃথিবীতে ও আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তিআর আল্লাহ্‌ জানেন, তোমরা জান না [সূরা আন-নূরঃ আয়াত ১৯]

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে পর্দার ফরজ বিধান মেনে চলার তৌফিক দান করুন! অশ্লীলতা ও বেহাপনার সয়লাবসহ সমাজের সকল প্রকার কলুষতা থেকে রক্ষা করুন! কলুষতার সয়লাব থেকে সমাজকে সংশোধন করে মদীনাতুন্নবীর ন্যায় তাকওয়া ভিত্তিক কল্যাণময় সমাজ গড়ার তৌফিক দিন! এবং তার মাহবুব বান্দাগণের অন্তর্ভূক্ত করুন! আ-মী-ন।


No comments:

Post a Comment